লাগবে না।
ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখুক। আপনার তো বেঁচে থাকারই কথা না।
সে হাসল। মতিন সাহেব লোকটির দিকে ভাল করে তাকালেন। অসম্ভব রোগা লম্বা একজন মানুষ। অতিরিক্ত রকমের ফর্সা। হাতের নীল শিরা চামড়া ভেদ করে ফুটে রয়েছে। সরল ধরনের লম্বাটে মুখ। চোখে এক ধরনের শান্ত ভাব আছে, যা শুধুমাত্র পশুদের চোখেই দেখা যায়।
গাড়িতে উঠেই লোকটি ঘুমিয়ে পড়ল। এটা ভাল লক্ষণ না। প্রচণ্ড আঘাতে মস্তিষ্কে রক্তপাত হলে ঘুম পায়। সেই ঘুম সচরাচর ভাঙ্গে না। ঘুমুতে ঘুমুতে কমায় চলে যায়। কমা থেকে মৃত্যু।
মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা উনি কি ঘুমুচ্ছেন?
হ্যাঁ মা।
উনার কিন্তু খালি পা।
তিনি তাকিয়ে দেখলেন সত্যি সত্যি খালি পা। পায়ে নিশ্চয়ই স্যাণ্ডেল ছিল–ছিটকে পড়েছে। লোকটিকে গাড়িতে ওঠানোর সময় খেয়াল হয়নি। এখন স্যাণ্ডেলের জন্যে আবার ফিরে যাবার কোন অর্থ হয় না।
মিতুর মুখ থেকে ফ্যাকাশে ভাব এখনো দূর হয়নি। তার বয়স দশ। এ বছর ক্লাস ফাইভে উঠেছে। তার ক্ষুদ্র জীবনে এমন ভয়ংকর ঘটনা আর ঘটেনি। সে সোনার কেল্লা বইটা তার চোখের সামনে ধরে রেখেছে কিন্তু বই-এ মন দিতে পারছে না।
বাবা!
কি মা।
আমার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে।
কিসের ভয়?
মনে হচ্ছে উনি মরে গেছেন।
আরে দূর। তুমি চুপচাপ বই পড়তে থাক। আমি বরং গান দিয়ে দি। দেব?
দাও।
ভল্যুম অনেকখানি বাড়িয়ে মতিন সাহেব ক্যাসেট চালু করলেন। তিনি ভেবেছিলেন গানের শব্দে লোকটি জেগে উঠবে। তা হল না। লোকটি সীটে হেলান দিয়ে পাথরের মত পড়ে আছে। মতিন সাহেবের মনে হল মিতুর কথাই হয়ত সত্যি–লোকটি মরে গেছে। ক্যাসেটে গান হচ্ছে। মতিন সাহেব মন দিয়ে গানের কথা শুনতে লাগলেন। কোন কিছুতে নিজেকে ব্যস্ত রাখা।
‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা
কহো কানে কানে শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।
ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে সদাই ভাবনা
যা কিছু পায় হারায়ে যায়, না মানে সান্ত্বনা।।’
মিতু ফিস ফিস করে বলল, বাবা।
কি মা?
লোকটা মরে গেলে আমরা কি করব?
আমরা তার আত্মীয়-স্বজনকে খবর দেব।
তোমাকে পুলিশে ধরবে না?
না। এটা একটা এ্যাকসিডেন্ট।
আমার মনে হচ্ছে পুলিশ তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে। ভয় লাগছে বাবা।
ভয়ের কিছু নেই। লোকটা মরে নি।
মতিন সাহেব আড় চোখে তাকালেন। লোকটি নড়ছে না। নিঃশ্বাস ফেলছে বলেও মনে হচ্ছে না। সম্ভবত মারা গেছে। প্রথমেই তাকে একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। তিনি গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন। স্পীডোমিটারের কাঁটা আবার নব্বই এর কাছাকাছি চলে এল।
না লোকটি মরেনি।
ডাকামাত্র উঠে বসল। হেঁটে হেঁটে ঢুকল ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার জাকির হোসেন মতিন সাহেবের বন্ধু। তিনি দেখেটেখে বললেন, তেমন কিছু না। দু-এক জায়গা ছিঁড়ে গেছে। ওয়াশ করে ব্যাণ্ডেজ লাগিয়ে দিচ্ছি। হাঁটুতে স্টীচ লাগবে। দ্যাটস ইট।
মতিন সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, মাথায় চোট পেয়েছে কিনা দেখবেন? সারা রাস্তা ঝিমুতে ঝিমুতে এসেছে।
ডাক্তার সাহেব সহজ গলায় বললেন, মাথায় চোট পেয়েছে বলে মনে হয় না। চোখের মণি ডাইলেটেড হয়নি। রিফ্লেক্স এ্যাকশন ভাল। লম্বা ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে। একটা পেইন রিলিভার দিয়ে দিচ্ছি–ব্যথা বেশী হলে খেতে হবে। প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে ডাক্তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। লোকটি বিব্রত চোখে তাকাল। যেন খুব অস্বস্তি বোধ করছে।
বলুন, নাম বলুন।
আমার কোন নাম নেই।
নাম নেই মানে?
লোকটি মাথা নিচু করে ফেলল। আড় চোখে তাকাল মতিন সাহেবের দিকে। তার চোখে চাপা সংশয়। মতিন সাহেব খানিকটা হকচকিয়ে গেছেন। তাকাচ্ছেন মিতুর দিকে। ডাক্তার সাহেব বললেন, আপনি কি নাম মনে করতে পারছেন না?
না।
আপনার পরিচিত কারোর নাম মনে আছে?
লোকটি মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, এই মেয়েটার নাম মিতু।
এই মেয়ে ছাড়া অন্য কারোর নাম মনে পড়ছে না?
না।
আপনি কি করেন বলুন তো?
কিছু করি না।
কিছু নিশ্চয়ই করেন–এখন মনে করতে পারছেন না, তাই না?
জি।
আচ্ছা, এ্যাকসিডেন্টের পরের ঘটনা মনে আছে?
আছে।
দু-একটা বলুন তো শুনি।
মিতু তার বাবার সঙ্গে কথা বলছিল। গান হচ্ছিল।
কি গান?
লোকটি মতিন সাহেবকে পুরোপুরি চমকে দিয়ে গানের প্রতিটি লাইন বলে গেল। মতিন সাহেব যেমন চমকালেন ডাক্তার তেমন চমকালেন না। সহজ গলায় বললেন, সাময়িক এ্যামনেশিয়া। শকটা কেটে গেলে ঠিক সয়ে যাবে। ভাল মত রেস্ট হলেই স্মৃতি ফিরে আসবে। ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। দশ মিলিগ্রাম করে ফ্রিজিয়াম ঘুমুতে যাবার এক ঘন্টা আগে খেতে হবে।
ডাক্তার লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কি বমি ভাব হচ্ছে?
জি না।
মাথা ঘুরছে?
ঘুরছে না তবে–কেমন যেন লাগছে।
আচ্ছা বসুন, এখানে আমি আপনার ব্লাড প্রেসার মাপি।
মতিন সাহেব ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে চলে এলেন। তাঁকে একটা সিগারেট খেতেই হবে। মিতু তার পেছনে পেছনে এল। রাস্তার পাশের সিগারেটের দোকান থেকে সিগারেট কিনলেন। মুখে এখনো থুথু জমা হচ্ছে। একটা মিষ্টি পান কিনলেন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, পান খাবিরে মিতু?
খাব। মিষ্টি পান।
মিতু পান মুখে দিয়ে বড়দের মত পিক ফেলে বলল, লোকটাকে এখন আমরা কি করব?
বুঝতে পারছি না। ভাবছি একটা শার্ট এবং প্যান্ট কিনে দেব। শ দুএক টাকা দিয়ে দেব। ও বাড়ি চলে যাবে।