জি।
এখানে বসে আছেন কেন?
বাসায় কান্নাকাটি হচ্ছে–আমি ভাবলাম একটু দূরেই থাকি। জামাইরা কখনো বাড়ির মেইন স্ট্রীমের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাছাড়া বাড়ির কেউ চায়ও না জামাইরা তাদের সঙ্গে মিশে যাক। ভাল কথা, আপনি কে?
আমার নাম আগস্ট।
ও আচ্ছা, আপনি আগস্ট?
জি।
মাই গড। আমি ভেবেছিলাম অদ্ভুত একজন কাউকে দেখব। ঋষিদের মত চুল, দাড়ি–লম্বা, ফর্সা। আপনাকে তো খুবই নরম্যাল একজন মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
খুব নরম্যাল না। আমি পুরোনো কথা কিছুই মনে করতে পারছি না।
এ্যামনেশিয়া?
ডাক্তার তাই বলেছে।
আপনার সম্পর্কে এত সব অদ্ভুত কথা কেন রটছে বলুন তো? মন্টুকে নাকি গাছ বানিয়ে দিয়েছেন?
আগস্ট বসতে বসতে বলল, ঠিক বানাইনি, বানানোর কৌশল ব্যাখ্যা করলাম।
সিরাজুল ইসলাম বিস্মিত হয়ে বললেন, গাছ বানানোর কৌশল আবার কি?
আগস্ট কোন জবাব দিল না। সিরাজুল ইসলাম সাহেব একটু সরে বসলেন। লোকটা উন্মাদ হতে পারে। কিছু কিছু উন্মাদ সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চলাফেরা করে। তাদের পাগলামি হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে। এ-ও মনে হচ্ছে সে রকম কেউ। দীর্ঘদিন একে এ বাড়িতে পোষা হচ্ছে কেন সেও এক রহস্য।
সিরাজুল ইসলাম উঠে দাঁড়ালেন।
আগস্ট বলল, চলে যাচ্ছেন?
সিরাজুল ইসলাম জবাব দিলেন না। পাগল মানুষের প্রতিটি কথার জবাব দেয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। আগস্ট বলল, আপনার কাছে সিগারেট থাকলে দয়া করে একটা দিয়ে যান।
সিরাজুল ইসলাম আবার ভাবলেন, বলবেন, আমি সিগারেট খাই না। মিথ্যা, কথাটা চট করে মুখে এল না। তিনি সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন–দুটা মাত্র সিগারেট। তিনি প্যাকেটটাই কাঁঠাল গাছের দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
আগস্ট বলল, দিয়াশলাই? দিয়াশলাই না দিয়ে চলে যাচ্ছেন। তিনি দিয়াশলাইও ছুঁড়ে ফেললেন।
সাবেরকে হাসপাতালে নেয়ার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। একমাত্র উপায় ছিল জোর করে এম্বুলেন্সে তোলা–মতিন সাহেব নিষেধ করলেন। অবোধ শিশুদের উপর জোর খাটানো যায়। সাবের শিশু নয়, অবোধও নয়। তাছাড়া যে চিকিৎসা এখানে করা সম্ভব হচ্ছে না সে চিকিৎসা হাসপাতালে কিভাবে করা হবে? মতিন সাহেব কঠিন গলায় বললেন, সাবের, তুমি যে মারা যাচ্ছ তা কি বুঝতে পারছ?
পারছি–জীবাণুরা আমাকে বলেছে।
ওদের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা তাহলে এখনো হচ্ছে?
হ্যাঁ, হচ্ছে।
তুমি যে নিতান্তই পাগলের মত কথা বলছ তা কি বুঝতে পারছ?
পারছি–কিন্তু আমি যা বলছি তা সত্য। জীবাণুরা যে কোন ভাবেই হোক আমার সঙ্গে কম্যুনিকেট করতে পারছে। তোমাদের ব্যাপারটা আমি বোঝাতে পারছি না, কারণ কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার গ্রহণ করার মত মানসিক প্রস্তুতি তোমাদের নেই।
তুমি তো আমাদেরই একজন। তোমার ভেতর সেই মানসিক প্রস্তুতি কি করে হয়ে গেল?
মিস্টার আগস্ট আমাকে সাহায্য করেছেন।
মতিন সাহেব থমথমে গলায় বললেন, সে তোমাকে জীবাণুর সঙ্গে কথা বলা শিখিয়েছে?
তা–না, ব্যাপারটা কি হয়েছে আমি তোমাকে বলি–মানুষের অসুখ কি করে হয় ঐ ব্যাপারটা মিস্টার আগস্ট জানতেন না। আমি একদিন তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, পুরো ব্যাপারটা হয় জীবাণুঘটিত নয় ভাইরাসঘটিত। তখন তিনি খুব আগ্রহ করে জানতে চাইলেন–আচ্ছা ঐ জীবাণুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না? ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারলে খুব সুবিধা হত। তারপর থেকে আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি …।
তুমি তাহলে প্রথম ব্যক্তি যে জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলল?
এর আগেও হয়ত কেউ কেউ করেছে–এটা তেমন কঠিন কিছু না।
এর আগে কেউ যদি করে থাকে তাহলে এতদিনে আমরা কি তা জানতে পারতাম না?
না। যাদের এই সৌভাগ্য হয়েছে তারা ভেবেছে এটা এক ধরনের স্বপ্ন। এক ধরনের ভ্রান্তি। তারা নিজেরাও ঠিক বিশ্বাস করেনি, কাজেই কাউকে বলেনি।
তোমার ধারণা এটা স্বপ্ন বা ভ্রান্তি নয়?
আমার তাই ধারণা।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে সাবের। তোমার ব্রেইন এখন ননফাংশানিং।
সাবের চোখ বন্ধ করে ফেলল। দীর্ঘ সময় কথা বলার কারণে সে ক্লান্তিতে ভেঙ্গে পড়েছে। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হল। মতিন সাহেব সুরমার দিকে তাকালেন। সুরমা তার ছেলের মাথার কাছে মূর্তির মত বসে আছেন। তাঁর পেছনে খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে নিশা। সে পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেছে। মতিন সাহেব মিস্টার আগস্টের খোঁজে বের হলেন। আগস্ট ফিরে এসেছে এবং কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আছে এই খবর তিনি পেয়েছেন।
মতিন সাহেবকে দেখে আগস্ট উঠে দাঁড়াল।
মতিন সাহেব তীব্র গলায় বললেন, আপনি কে ঠিক করে বলুন তো?
আগস্ট শান্ত গলায় বলল, আমি কে তা আমি জানি না। জানলে অবশ্যই বলতাম।
আপনি জানেন না আপনি কে?
জ্বি না। এবং মজার ব্যাপার কি জানেন–আপনি নিজেও জানেন না আপনি কে? এই পৃথিবীর কোন মানুষ জানে না সে কে? সে কোথা থেকে এসেছে–সে কোথায় যাবে।
আপনি আমার পরিবারে যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তা কি আপনি জানেন?
পুরোপুরি না জানলেও আঁচ করতে পারছি।
কাল সকালে সূর্য ওঠার পর এই বাড়িতে আমি আপনাকে দেখতে চাই না।
আমি কি বলছি বুঝতে পারছেন?
পারছি। আপনি চাইলে আমি এখনো চলে যেতে পারি!
এত রাতে কোথায় যাবেন?
হাঁটতে শুরু করব, তারপর আপনার মত একজন কেউ আমাকে পাবে… তাঁর বাসায় কিছুদিন থাকব। তারপর …
আপনার জীবন কি এই ভাবেই কাটছে?
আমি জানি না। সত্যি জানি না–জানলে আপনাকে জানাতাম। কাঁঠাল গাছের নিচে বসে আমি প্রায়ই ভাবি–আমি কে? পুরানো স্মৃতি বলে আমার কিছু নেই। আমি বাস করি বর্তমানে।