রাগ হচ্ছে বলেই রেগে রেগে কথা বলছি।
তুমি কি গাড়িটা পাঠাতে পারবে?
না। গাড়ি নিয়ে এষা সকালে বের হয়েছে, এখনও ফেরেনি।
মতিন সাহেব টেলিফোন রেখে আগের জায়গায় এসে বসলেন। বুঝতে পারছেন নিশার সঙ্গে কঠিন ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের ব্যবহার তিনি তার মেয়েদের সঙ্গে কখনো করেন না। সকাল থেকেই মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। বেলা যতই বাড়ছে মেজাজ ততই খারাপ হচ্ছে। এখন দুপুর।
মিতু ঢুকলো, বাবা আবার টেলিফোন। নিশা আপা ফোন করেছে। তুমি নাকি তাকে বকা দিয়েছ? সে কাঁদছে।
কাঁদুক।
মিতু ফিরে গেল। নিশাকে বলল, বাবাকে বলেছিলাম তুমি কাঁদছ। বাবা বললেন–কাঁদুক।
সুরমা অফিসে হাজিরা দিতে গেছেন।
ব্যাংকের চাকরিতে হুট করে এ্যাবসেন্ট করা যায় না। এ.জি.এম-কে জানাতে হবে। আজকের দিন ছাড়াও আরো দুদিন ছুটি নেবেন। তাঁর মাথায় যন্ত্রণা অন্যদিন সন্ধ্যার পর হয়, আজ শুরু হয়েছে দুপুর থেকে। সাবের তার ঘরে একা। নার্স মেয়েটি ঘরের বাইরে বারান্দায় চেয়ারে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। মেয়েটি অসম্ভব রোগা–শ্যামলা চেহারা। সরল মুখ। চোখ দেখে মনে হয় কোন কারণে ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। বাইশ তেইশ বছর বয়স, রোগা বলেই বোধ হয় আরো কম দেখা যায়। নার্স এর পেশায় মেয়েটি দুবছর কাটিয়েছে–এর মধ্যেই রোগ এবং রোগী সম্পর্কে নির্বিকার ভাব চলে আসা উচিত ছিল, তা আসেনি।
মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রুগীকে এন্টিবায়োটিক খাওয়ানোর সময় হয়ে গেছে। রুগী এখন ঘুমুচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গিয়ে হলেও অষুধ খাওয়াতে হবে। এক মিনিট এদিক-ওদিক হতে দেয়া যাবে না।
সাবেরের গায়ে হাত দেয়া মাত্র সে চোখ মেলল।
স্যার, আপনার অষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।
সাবের বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে স্যার বলছেন কেন? আগেও বলব ভাবছিলাম। মনে থাকে না–আপনি নাম ধরে ডাকবেন। ভাল কথা–আপনার নাম কি?
হৈমন্তী।
বাহ, চমৎকার। হেমন্ত ঋতুতে জন্ম বলেই কি হৈমন্তী?
জী।
আমাদের এখানে একজন আছেন তার নাম মিঃ আগস্ট। তাঁর সঙ্গে কি কথা বলেছেন?
জি-না।
কথা বলে দেখবেন। চমৎকার মানুষ।
জ্বি–আচ্ছা, কথা বলব। নিন, অষুধটা খান।
আমি অষুধ খাব না বলে ঠিক করেছি।
কখন ঠিক করলেন?
কিছুক্ষণ আগে। চোখ বন্ধ করে এই ব্যাপারটাই ভাবছিলাম। আমি ভেবে দেখলাম কি জানেন? আমি চিন্তা করে দেখলাম–এই মুহূর্তে আমার শরীরে আছে লক্ষ কোটি জীবাণু। অষুধ খাওয়া মানে এদের ধবংস করা। সেটা ঠিক হবে না। আমাদের যেমন জীবন আছে, ওদেরও জীবন আছে–সুখ-দুঃখ আছে। একটি জীবনের জন্যে লক্ষ কোটি জীবন নষ্ট করার কোন কারণ দেখি না।
ছেলেমানুষি করবেন না–অষুধ খান।
না। অষুধ থাক–আপনি বরং একটা কবিতা শুনুন।
আগে অষুধ খান–তারপর শুনব। তার আগে না।
বললাম তো অষুধ খাব না।
হৈমন্তী মতিন সাহেবকে ডেকে নিয়ে এল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি নাকি অষুধ খেতে চাচ্ছ না?
না। অষুধ খাওয়া মানে লক্ষ কোটি জীবাণুর মৃত্যুর কারণ হওয়া।
অষুধ না খেলে তুমি নিজে মারা যাবে। তোমার শরীরেও লক্ষ কোটি জীবন্ত কোষ আছে। ওদেরও মৃত্যু হবে।
তোমার কথা খুবই ঠিক বাবা। তবে যুক্তিতে ভুল আছে। আমাদের শরীরে লক্ষ কোটি জীবকোষ থাকলেও আমাদের একটি মাত্র চেতনা। কিন্তু জীবাণুগুলির স্বাধীন সত্তা আছে। এরা প্রত্যেকেই আলাদা।
তোমাকে কে বলেছে? জীবাণুগুলির সঙ্গে তোমার কি কথা হয়েছে?
জ্বি হয়েছে।
কখন কথা হল?
পরশু রাতে প্রথম কথা হয়েছে। তারপরেও কয়েকবার কথা হয়েছে। দীর্ঘ সময় তাদের সঙ্গে কথা বলা একটা সমস্যা–সবাই এক সঙ্গে কথা বলতে চায়–আর কথা বলে খুব দ্রুত …।
তুমি বোধ হয় বুঝতে পারছ না যে তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বাবা।
জীবাণুদের সঙ্গে কথা বলার এই কায়দা তোমাকে কে শিখিয়েছেন? মিস্টার আগস্ট??
কথা বলছ না কেন? মিস্টার আগস্ট শিখিয়েছেন?
কেউ শেখায়নি। আমি নিজে নিজেই শিখেছি।
মতিন সাহেব কিছু না বলে বারান্দায় নিজের জায়গায় ফিরে গেলেন। সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল–সিগারেট আনতে পাঠালেন। দারোয়ানকে বলে দিলেন–মিস্টার আগস্ট আসামাত্র যেন তাকে খবর দেয়া হয়।
মিতু এসে বলল, এষা আপু এসেছে।
মতিন সাহেব বললেন, আমার কাছে আসতে বল।
ও আসবে না। দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।
কাঁদছে বুঝলে কি করে?
শব্দ শোনা যাচ্ছে।
আচ্ছা, ঠিক আছে যাও।
কোথায় যাব?
কোথায় যাবে আমি জানি না। আপাতত আমার সামনে থেকে যাও।
তুমি আমার উপর রাগ করছ কেন? আমি কি করলাম?
যাও আমার সামনে থেকে। যাও বলছি।
মিতুর চোখে পানি এসে গেল। সে চোখ মুছতে মুছতে বাবার সামনে থেকে চলে গেল এবং পর মুহূর্তেই ফিরে এসে বলল, বাবা নিশা আপু এসেছে।
মিস্টার আগস্ট এলেন সন্ধ্যার পর।
বাসায় তখন তুমুল উত্তেজনা। এম্বুলেন্স এসেছে–সাবেরকে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সুরমা ব্যাকুল হয়ে কঁদছেন। নিশা এবং এষা কাঁদছে না, তবে পুরোপুরি হকচকিয়ে গেছে। মিস্টার আগস্টের বাড়িতে ঢােকা কেউ লক্ষ্য করল না–সে চলে গেল কাঁঠাল গাছের দিকে। সেখানে আগে থেকেই কে যেন বসে আছে। মোটাসোটা একজন মানুষ।
আগস্ট বলল, কে?
লোকটি দারুণ চমকে গেল। একজন বয়স্ক মানুষ এতটা চমকায় না।
আগস্ট আবার বলল, ভাই, আপনি কে?
আমি সিরাজুল ইসলাম।
ও আচ্ছা চিনেছি–আপনি মিতুর সবচেয়ে বড় বোনের হাসব্যাণ্ড?