তারপরেরটা তারপর। আপাততঃ প্রথম দুটি কাজ কর।
এষা উঠে দাঁড়াল। শুরুতে তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল সে দরজা খুলে চলে যাবে। তা সে করল না। দরজা বন্ধ করে শুকনো গলায় বলল, এখন কি? জুবায়ের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লম্বা লম্বা টান দিচ্ছে সিগারেটে। ঘর সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে আছে।
সুরমা ছেলের বিছানার কাছে বসে আছেন। সাবেরের আকাশ পাতাল জ্বর। দুজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হয়েছে। দুজনের কেউই এখনো এসে পৌছান নি। সুরমা থমথমে গলায় বললেন, তোর এমন অসুখ আমি তো কিছুই জানি না।
তুমি ব্যস্ত থাক–তোমাকে বলিনি।
এমন কি ব্যস্ত থাকি যে অসুখের খবরটাও বলা যাবে না।
সাবের ক্ষীণ স্বরে বলল, বৃষ্টিতে ভেজাটা ঠিক হয়নি। লোভ সামলাতে পারলাম না।
কবে বৃষ্টিতে ভিজেছিস?
কাল রাত তিনটার দিকে। মিঃ আগস্ট বললেন–তিনি বৃষ্টিতে ভিজবেন .. . শুনে আমার খুব লোভ লাগল …
সুরমা সাবেরকে কথা শেষ করতে দিলেন না। কঠিন মুখে একতলায় নেমে এলেন। মিস্টার আগস্টকে পাওয়া গেল না। সে নাকি ঘুরতে বের হয়েছে। আরেকটি দৃশ্য দেখে সুরমা খানিকটা চমকালেন–হরিবাবু বিছানায় উবু হয়ে বসে একা একা লুডু খেলছেন। গভীর মনযোগের সঙ্গে খেলছেন। সুরমা যে ঘরে ঢুকেছেন–এই দৃশ্যটিও তার চোখে পড়েনি।
মিতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন
মিতু বলল, বাবা তোমার টেলিফোন। মতিন সাহেব বললেন, বলে দে আমি বাসায়। নেই। তিনি দোতলার বারান্দায় রাখা ইজি চেয়ারে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছেন। একটার পর একটা সিগারেট খেয়ে যাচ্ছেন। দুঘণ্টায় নটি সিগারেট খাওয়া হয়েছে। কোন কিছুতেই তার মন বসছে না। সাবেরের অসুখের এতটা যে বাড়াবাড়ি তা তিনি বুঝতেই পারেননি। ছেলের সঙ্গে ইদানীং তার যোগাযোগ নেই বললেই হয়। সাবের তাঁর ভয়ে অস্থির হয়ে থাকে। এটা জানেন বলেই তিনি নিজেকে দূরে দূরে রাখেন। তার মানে এটা না যে সাবের অসুস্থ হলেও তিনি জানবেন না। ডাক্তারের কথা শুনে তিনি বেশ বিচলিত বোধ করছেন। দুজন ডাক্তারই বললেন, ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দিন।
তিনি বললেন, কেন?
বেটার কেয়ার হবে।
এইখানে কি বেটার কেয়ার হবে না বলতে চাচ্ছেন?
তা-না। হবে নিশ্চয়ই তবে হাসপাতালে সব সময় হাতের কাছে ডাক্তার থাকবে।
প্রয়োজন হলে এখানেও হাতের কাছে ডাক্তার রাখব। তাছাড়া আমার ছেলে নিজেও একজন ডাক্তার। রেকর্ড নম্বর পেয়ে এম.বি.বি.এস. পাশ করেছে।
কোন ইমার্জেন্সি হলে হাতের কাছে সবকিছু থাকবে। এই জন্যেই হাসপাতালের কথা বলা। অন্য কোন কারণ না।
ইমার্জেন্সি হবে এ রকম আশংকা কি করছেন?
হ্যাঁ করছি। অবস্থা ভাল না।
মতিন সাহেব ছেলেকে হাসপাতালে পাঠাননি। সার্বক্ষণিক সেবার জন্যে একজন নার্স এনেছেন। ডাক্তার একজনও রাখতে চেয়েছিলেন, সাবের রাজি হয়নি। আগ্রহ এবং আনন্দের সঙ্গে বলেছে–ডাক্তার লাগবে কেন বাবা? আমি নিজেই তো ডাক্তার। আগে সব ভুলে গিয়েছিলাম–এখন সব মনে পড়ছে। ফার্মাকোলজির বইটা হাতে নিয়ে যে কোন প্রশ্ন কর–আমি বলে দেব।
সাবেরের কথাবার্তা ঠিক সুস্থ মানুষের কথাবার্তা নয়। যে ছেলে বাবার ভয়ে অস্থির থাকতো আজ সে বাবার সঙ্গে বন্ধুর মত গলায় কথা বলছে। স্বাভাবিক অবস্থায় এভাবে কথা বলা সম্ভব নয়।
বাবা, আমার সমস্যাটা কি ডাক্তাররা তোমাকে বলেছে–?
না।
আমাকেও বলেনি–তবে তারা সন্দেহ করছেন–চিকেন পক্স দূষিত হয়ে গ্যাংগ্রীনের মত হয়ে গেছে। তুমি কি আমার গা থেকে পচা গন্ধ পাচ্ছ?
না।
পচা গন্ধ পেলে বুঝতে হবে গ্যাংগ্রীন। গ্যাংগ্রীনের Causative Agents কি, বলব?
বলতে ইচ্ছে হলে বল।
Clostrodium welchii, gram positive, anaerobic bacilli … বাবা আমি কিন্তু সব মুখস্থ বলে যাচ্ছি।
তাই তো দেখছি।
একজন ভাল ডাক্তারের যে জিনিসটা সবচে বেশী দরকার তা হচ্ছে তীক্ষ্ণ স্মরণশক্তি।
কথা না বলে চুপচাপ শুয়ে থেকে রেস্ট নেয়াটা বোধ হয় ভাল।
মতিন সাহেব ছেলের কাছ থেকে সরে এসে বারান্দায় বসেছেন। সাবেরের পাশে তার মা এবং নার্স মেয়েটি আছে। সুরমা অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। নার্স মেয়েটিও ভয় পেয়েছে।
মিতু আবার এসে বলল, বাবা তোমার টেলিফোন।
মতিন সাহেব বললেন, বল বাসায় নেই।
এক মিথ্যা দুবার বলা যায় না বাবা। মিস্টার আগস্ট বলেছেন।
তোমাকে যা বলতে বলেছি বল।
বড় আপা টেলিফোন করেছে–নিশা আপু।
মতিন সাহেব যন্ত্রের মত উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন।
বাবা, কেমন আছ?
ভাল।
বাসার সবাই ভাল?
হ্যাঁ।
মিথ্যা কথা বলছ কেন বাবা? সাবেরের তো খুব অসুখ।
হ্যাঁ ওর শরীরটা ভাল নেই।
এই খবর তোমরা আমাকে জানাওনি।
ভুল হয়ে গেছে।
এ রকম ভুল ইদানীং তোমাদের খুব ঘন ঘন হচ্ছে। তুমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছিলে। একটা লোককে প্রায় মেরেই ফেলেছিলে–তাকে তুলে এনেছ। এখন সে আমাদের বাসাতেই আছে–এই খবরও দাওনি।
এটা তেমন কোন খবর না।
অবশ্যই বড় খবর। লোকটা অদ্ভুত অদ্ভুত সব কাণ্ড করে বেড়াচ্ছে …
কোনই অদ্ভুত কাণ্ড করছে না।
মিতু বলল করছে, মন্টু মামাকে নাকি বটগাছ বানিয়ে দিয়েছে …
মিতু কি বলছে–তাই বিশ্বাস করে বসে আছিস?
মিতু তো বাবা কখনো মিথ্যা কথা বলে না।
বেশ, বাসায় এসে তাহলে তোর বটগাছ মন্টু মামাকে দেখে যা। বটগাছের নীচে বসে খানিকক্ষণ হাওয়া খেয়ে যা।
তুমি এমন রেগে রেগে কথা বলছ কেন বাবা?