আরতী মুখ কালো করে ঘরের বাতি নিভিয়ে বাইরে চলে গেল। আর তখনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল।
এতদিন পর একই ঘটনা আবার কি করে ঘটল? রহস্যটা কি? হরিবাবু ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। লোকটাকে দেখতে পেলেন না।
মিস্টার আগস্ট দোতলায় উঠে এসেছে।
সাবেরের ঘরে হালকা টোকা দিয়েছে। সাবের সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বলল, ভাই আসুন।
এখনো জেগে আছেন?
আপনার জন্য অপেক্ষা করছি। জানতাম রাত তিনটার দিকে আপনি আসবেন। বসুন, ঐ চেয়ারে বসুন। আমার কাছে আসবেন না।
কেন?
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হয়েছে। আমাকে ডাবল অসুখে ধরেছে।
ডাবল নিউমোনিয়া?
জি না। নিউমোনিয়া শুধু বাঁ লাংসটা ধরেছে। ডানটা ঠিক আছে।
ডাবল অসুখ বললেন যে?
চিকেন পক্স হয়ে গেছে রে ভাই। সারা শরীরে ফুটে বের হয়েছে। দারুণ ইন্টারেস্টিং। একসঙ্গে কয়েকটি অসুখ সম্পর্কে জানতে পারছি।
চিকিৎসা করাচ্ছেন?
না। রোগের গতি-প্রকৃতি দেখছি, চিকিৎসা করাটা ঠিক হবে না।
আবার যদি মরে টরে যান।
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। নো রিস্ক নো গেইন।
আমার মনে হয় না আপনি মরবেন। মানুষের মনের জোর যখন পুরোপুরি চলে যায় মৃত্যু তখনি আসে। আপনার মন শক্তই আছে।
সত্যি কথা বলেছেন। আমার মনের জোর একশগুণ বেড়ে গেছে। আমার যে এত বড় অসুখ বাসার কেউ জানেই না। হসমুখে সবার সঙ্গে গল্প করি। সবার ধারণা সামান্য ঠাণ্ডা। এদিকে চিকেন পক্সে গা পচে যাচ্ছে।
তাই না-কি।
হ্যাঁ ঘা হয়ে গেছে। ইনফেকশন। এন্টিবায়োটিক শুরু করা উচিৎ।
শুরু করবেন না?
না। দেখি। আরো কিছুদিন দেখি।
জ্বর আছে?
জ্বর তো আছেই। জ্বর থাকবে না?
সাবের উঠে বসল। গলার স্বর নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, আসল ব্যাপার আমি এখনো আপনাকে বলিনি। আমার স্মৃতিশক্তি এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে আছে। যা পড়ি মনে থাকে।
অসুখের মধ্যেও পড়ছেন?
পড়ব না? কি বলেন আপনি? ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছি।
কবিতা? কবিতাও পড়ছেন নাকি?
সাবের লজ্জিত মুখে বলল, জ্বি তাও মাঝে মধ্যে পড়ছি। জানি কাজটা ঠিক হচ্ছে না কিন্তু কেন জানি ভাই ভাল লাগে।
লোকটা চেয়ারে পা উঠিয়ে বসল। সহজ গলায় বলল, সবশেষে যে কবিতাটা পড়লেন সেটা শোনান তো।
সত্যি শুনতে চান?
হ্যাঁ চাই।
সাবের বালিশের নীচ থেকে রুলটানা খাতা বের করল। লাজুক গলায় আবৃত্তি শুরু করল–
নারে মেয়ে, নারে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না। আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত,
এমন অনেক ব্যথা আকাঙ্ক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে। তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হয়ে ঘুমো।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে উঠেনি তার গান।
ওরে বোকা,
এখনো রয়েছে রাতি, দরজায় পড়েনি তার টোকা
কবিতা পড়তে পড়তে সাবেরের চোখে পানি এসে গেল। সে লজ্জিত চোখে তাকিয়ে অপ্রস্তুতের হাসি হাসল।
লোকটা বলল, সাবের সাহেব আমার একটা কথা রাখবেন?
অবশ্যই রাখব। কি কথা বলুন তো?
আপনি ডাক্তারী পড়শোনাটা ছেড়ে দিন। কবিতা লিখতে শুরু করুন। আপনি পারবেন। সবাই সব কিছু পারে না। একেক জনকে একেক ধরনের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়।
কে পাঠান?
লোকটি এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
সাকের দুঃখিত গলায় বলল, চলে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
কেন বলুন তো?
দেখছেন না–ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।
ভাবছি বৃষ্টিতে খানিকক্ষণ ভিজব।
বৃষ্টিতে ভিজবেন? আপনি খুবই স্ট্রেঞ্জ মানুষ।
সব মানুষই স্ট্রেঞ্জ।
হ্যাঁ তাও ঠিক। আমারো বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছা করছে।
খুব বেশী করছে?
হ্যাঁ খুব বেশী। মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতে না পারলে মরে যাব।
তাহলে চলে আসুন।
চলে আসব? বাসার কেউ দেখে ফেললে দারুণ হৈ চৈ করবে।
কেউ দেখবে না। ঠাণ্ডা হাওয়ায় সবাই আরাম করে ঘুমুচ্ছে।
তাহলে চলে আসি কি বলেন?
আসুন।
উঠতে পারছি না–হাতটা ধরে টেনে তুলুন।
তারা দুজন কাঁঠাল গাছের নীচে গিয়ে বসল। সাবের মুগ্ধ গলায় বলল, অপূর্ব! অপূর্ব!
ভোরবেলা মন্টু এসে উপস্থিত
ভোরবেলা মন্টু এসে উপস্থিত। তার চোখ লাল। জামা কাপড় কাদা-পানিতে মাখামাখি। খালি পা, চোখে-মুখে কেমন দিশেহারা ভঙ্গি। প্রথমেই দেখা হল এষার সঙ্গে। এষা বলল, ব্যাপার কি মামা?
মন্টু থমথমে গলায় বলল, ঐ ব্যাটা আছে না গেছে?
মিস্টার আগস্টের কথা বলছ?
হুঁ।
আমার কাছ থেকে একটা কথা শুনে রাখ। তার ত্রিসীমানায় যাবি না। ভুলেও। ব্যাটার কথা শুনে আমার জীবন সংশয় হয়ে গেল। আরেকটু হলে গাছ হয়ে যেতাম।
গাছ হয়ে যেতে মানে?
ইন ডিটেইলস কিছু বলতে পারব না। মাথা ঘুরছে। রেস্ট নিতে হবে। জুতা জোড়াও গেছে। নতুন জুতা, পাঁচশ টাকায় কেনা। এষা।
জি মামা?
আমি যে ফিরে এসেছি ঐ লোককে বলবি না। খবরদার না। ঐ লোক ডেনজারাস লোক। ভেরী ডেনজারাস। ভুজুং ভাজুং দিয়ে আমাকে প্রায় গাছ বানিয়ে ফেলেছিল।
তুমি এসব কি বলছ মামা।
মন্টু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এষা বলল, মামা তুমি এক্ষুণি বাবার সঙ্গে দেখা কর। বাবা তোমার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। বাবার ধারণা, তোমার বড় রকমের কোন বিপদ হয়েছে।
বিপদ হতে যাচ্ছিল। অল্পের জন্যে বেঁচেছি।
মতিন সাহেব মন্টুর বক্তব্য মন দিয়ে শুনলেন। মন্টুর গল্প তিনি বিশ্বাস করছেন এমন মনে হল না। আবার অবিশ্বাস করছেন তাও মনে হল না। মতিন সাহেবের এক পাশে এষা অন্য পাশে মিতু। দুজনই গভীর আগ্রহে গল্প শুনছে। এষা গল্পের মাঝখানে দুবার হেসে ফেলল। মন্টু বলল, আরেকবার হাসলে চড় খাবি। একটা সিরিয়াস এক্সপেরিয়েন্স বলছি–আর তুই হাসছিস।