কারেক্ট কথা বলেছেন ভাই। এর চেয়ে গাছ হয়ে জন্মানো ভাল ছিল। মাঝে মাঝে গাছ হয়ে যেতে ইচ্ছা করে। হাসবেন না ভাই সত্যি বলছি।
গাছ হওয়া তো খুব সহজ।
খুব সহজ? কি বলছেন আপনি?
হ্যাঁ খুব সহজ। গভীর বনের মাঝামাঝি একটা ফাঁকা জায়গায় দুহাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। গায়ে কোন কাপড় থাকবে না। মাথায় রোদ পড়বে, বৃষ্টি পড়বে, রাতে চাঁদের আলো পড়বে। আস্তে আস্তে শরীরটা গাছের মত হয়ে যেতে থাকবে। প্রথম দিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণা হবে। আস্তে আস্তে কমে যাবে। রোদে পুড়ে গায়ের চামড়া শক্ত হতে থাকবে। পায়ের তলা দিয়ে শিকড় বেরুবে।
সত্যি বলছেন নাকি ভাই?
হ্যাঁ সত্যি।
কতদিন লাগে?
কারো জন্যে খুব অল্পদিন লাগে। আবার কারো জন্যে দীর্ঘ সময় লাগে।
আমার কতদিন লাগবে বলে মনে হয়?
বুঝতে পারছি না। আপনার ইচ্ছাশক্তির উপর নির্ভর করছে।
ট্রাই করে দেখতে ইচ্ছা হচ্ছে।
দেখুন না।
পুরোপুরি নগ্ন না হয়ে যদি একটা আণ্ডার ওয়্যার থাকে তাতে অসুবিধা হবে?
না। তবে পুরোপুরি নগ্ন হতেই অসুবিধা কি? কেউ তো দেখছে না।
সেটাও সত্যি। আচ্ছা ভাই আপনি অনেস্টলি বলুন তো–আমি কি দেখব চেষ্টা করে?
দেখুন। অন্তত একদিন এবং একরাত দেখুন। যদি দেখছেন পারছেন না, বাসায় চলে আসবেন।
মন্টুর ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগল। সে নিজের ভেতর অন্য এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করছে। সে গাঢ় স্বরে বলল, ব্রাদার একটা কথা।
বলুন।
আপনি এক কাজ করুন। গাড়ি নিয়ে চলে যান। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি। আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবেন আমি থেকে গেছি। কি জন্যে সেটা বলবেন না। ওরা হাসাহাসি করতে পারে।
জি আচ্ছা বলব না।
লোকটা বাসায় ফিরল বিকেল পাঁচটায়।
সে সরাসরি বাসায় আসেনি। গাড়ি নিয়ে সারা শহর ঘুরেছে। ড্রাইভার বিরক্ত হলেও কিছু বলে নি।
মতিন সাহেব বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন–তিনি লোকটাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে বিস্মিত হলেন। লোকটি বলল, ফিরতে খানিকটা দেরী করলাম। গাড়ি নিয়ে খুব ঘুরেছি। আশাকরি কিছু মনে করবেন না।
মন্টু? মন্টু কোথায়?
উনি মৌচাকে থেকে গেলেন। আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।
মতিন সাহেব কি বলবেন ভেবে পেলেন না। লোকটি গুন গুন করতে করতে নিজের ঘরের দিকে এগুচ্ছে–
সকাতরে ঐ কাদিছে সকলে শোন শোন পিতা
কহ কানে কানে শোনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গল বারতা।
সুরমাকে নিয়ে আজ চোখের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার কথা। মতিন সাহেব কোন উৎসাহ বোধ করছেন না। তার ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। তার মন বলছে লোকটিকে তাড়িয়ে দিতে হবে। অতি দ্রুত তাড়িয়ে দিতে হবে।
দুটি খাট পাশাপাশি
দুটি খাট পাশাপাশি। হরিপ্রসন্ন বাবু এক খাটে–অন্য খাটে মিস্টার আগস্ট। রাত প্রায় দশটা বাজে। কাজের মেয়ে ঘরেই রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। খাওয়া শেষ হয়েছে। হরিবাবু কিছুই প্রায় খেতে পারেননি। সন্ধ্যা থেকেই তাঁর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এখন বেশ বেড়েছে। তার মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস ঠিকই। নিতে পারছেন–ফেলতে পারছেন না। ফুসফুসে বাতাস ক্রমেই জমা হচ্ছে।
মিস্টার আগস্ট বলল, ভাই আপনার শরীরটা কি খারাপ?
হরিবাবু হঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?
হুঁ।
লুডু খেলবেন? মিতুর লুডু সেটটা আমার কাছে আছে।
হরিবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, লুডু?
হ্যাঁ লুডু। সাপ লুডু। এই খেলায় এক ধরনের উত্তেজনা আছে। উত্তেজনার কারণে–শারিরীক কষ্ট অনেকটা কমে যাবে। খেলবেন?
না।
খেলে দেখুন না। ভাল না লাগলে বন্ধ করে দেবেন।
হরিবাবু অবাক হয়ে দেখলেন লোকটা লুডু বোর্ড মেলে ধরেছে। পাগল নাকি লোকটা? তিনি শুনেছেন লোকটা গাড়ির ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। মাথাও যে খারাপ হয়ে গেছে সে কথা তাকে কেউ বলে নি।
তাই খেলবেন? নিন আপনি প্রথম দান দিন। সাপ লুডুর নিয়ম জানেন তো–এক না উঠলে ঘুটি ঘর থেকে বেরুবে না।
আমি খেলব না।
আপনার দানগুলি আমি চেলে দেব। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।
না–আমার শরীর ভাল না।
তা হলে তো আমাকে একা একাই খেলতে হয়।
হরিবাবু শুয়ে পড়লেন। কাজের মেয়েটা মশারী খাটিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ঘরে বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলো চোখে লাগছে। পাশের খাটে বসে লোকটা খট খট শব্দে লুডুর দান ফেলছে। হরিবাবু বললেন, বাতিটা নেভাবেন? চোখে আলো লাগছে।
ও আচ্ছা আচ্ছা। নিভিয়ে দিচ্ছি, আপনি ঘুমুনোর চেষ্টা করুন।
লোকটা বাতি নিভিয়ে বাইরে বেরুতেই–ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি পড়তে লাগল। হরিবাবুর তন্দ্রার মত এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রাও কেটে গেল। তিনি বিছানায় উঠে বসলেন। কারণ অনেক অনেকদিন আগের একটা ঘটনা তার মনে পড়ে গেছে। সেই ঘটনার সঙ্গে আজকের রাতের ঘটনার এত অদ্ভুত মিল–হরিবাবুর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
বিয়ের পর প্রথম শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন। চৈত্র মাস–অসহ্য গরম। আরতী অনেক রাতে ঘুমুতে এসে বলল–এই গরমে তুমি ঘুমুতে পারবে না–এক কাজ করলে কেমন হয়–এসো আমরা লুডু খেলি। সাপ লুডু।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, পাগল নাকি?
আরতী লুডু বোর্ড মেলে দিয়ে বলল, সাপ লুডু খেলার নিয়ম জাননা তো? এক না পড়লে ঘুটি বের হবে না।
আমি খেলব না। কি সব ছেলেমানুষী করছ।
তোমার দানগুলি আমি চেলে দেব। তোমাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি প্রথম দান দেই কেমন?
তিনি চুপ করে রইলেন। আরতী একা একাই খেলে যাচ্ছে। চাল দিচ্ছে। উত্তেজনায় তার মুখ ইষৎ লালচে। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, অন্য কোথাও গিয়ে খেল তো। কানের কাছে খট খট করবে না। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে যাও।