এষা।
জ্বি।
তুমি কি একটু পরীক্ষা করে দেখবে আমি ডিকশনারীটা পুরোপুরি মুখস্থ করতে পেরেছি কিনা।
আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেন?
আচ্ছা আর বলব না। আপনি কি দয়া করে দুএকটা কঠিন ইংরেজী শব্দ জিজ্ঞেস করবেন–আমি দেখতে চাই ডিকশনারী মুখস্থ করতে পারলাম কি না।
এষা কিছু না বলে উঠে চলে গেল। লোকটা আবার ডিকশনারী খুলে বসল। তার গায়ে চৈত্র মাসের কড়া রোদ এসে পড়েছে। সেদিকে তার জুক্ষেপও নেই। ঘণ্টাখানিক এইভাবেই পার হল। তখন মন্টুকে শিস দিয়ে আসতে দেখা গেল। সে উৎসাহের সঙ্গে বলল, ব্রাদার কি করছেন?
কিছু করছি না।
রোদে তো ভাজা ভাজা হয়ে গেলেন। চলুন ঘুরে আসি।
কোথায়?
আরে ব্রাদার চলুন না। গাড়ি করে যাব। গাড়ি করে ফিরে আসব। গায়ে হাওয়া লাগবে।
চলুন।
আপনার সঙ্গে আমার এখনো পরিচয় হয়নি। আমার সমস্যা কি জানেন? আমি আগ বাড়িয়ে লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারি না। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলতে এলে–খুবই ভাল কথা। কথা বলব। সেধে চা খাওয়াব। সিগারেট অফার করব। কেউ নিজের থেকে আমার কাছে না এলে আমি ভুলেও কিছু বলব না।
গাড়িতে উঠতে উঠতে মিস্টার আগস্ট বলল, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
মন্টু দরাজ গলায় বলল, চলুন না ভাই–শালবন দেখে আসি। চৈত্র মাসে শালবনের একটা আলাদা বিউটি আছে।
রাস্তা ফাঁকা, গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। লোকটি পেছনের সীটে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। মন্টু খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে। একটা বিড়াল দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসা এক কথা আর একটা জলজ্যান্ত মানুষ ছেড়ে দিয়ে আসা ভিন্ন কথা। কেমন যেন খুঁত খুঁত করছে। মন্টু উঁচু গলায় বলল, ব্রাদারের কি ধূমপানের অভ্যাস আছে?
জি না।
বেঁচে গেছেন। অসম্ভব পাজি নেশা। টাকা নষ্ট, স্বাস্থ্য নষ্ট। আমার দেড় প্যাকেটের মত লাগে। আগে দু প্যাকেট লাগতো। কমিয়ে দেড় করেছি।
লোকটি জবাব দিল না। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে। মন্টু একের পর এক সিগারেট টেনে যেতে লাগল। সে বুঝতে পারেনি তার এতটা অস্বস্তি লাগবে।
গাড়ি এসে মৌচাকে শালবনের কাছে থামল। মন্টু ক্ষীণস্বরে বলল, ব্রাদার নামুন।
লোকটা নামল। হাসিমুখেই নামল।
ব্রাদার আপনার হাতে এটা কি বই?
ডিকশনারী।
ডিকশনারী নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন। ব্যাপার কি?
ডিকশনারীটা মুখস্থ করে ফেলেছি চৰ্চার ব্যাপার তো, চর্চা না থাকলে ভুলে যাব। এই জন্যে সঙ্গে সঙ্গে রাখি। সময় পেলেই পাতা উল্টাই।
সত্যি মুখস্থ করে ফেলেছেন?
হ্যাঁ।
বলেন কি ব্রাদার, আপনি তো মহাকাবিল লোক। দেখি ডিকশনারীটা দিন তো আমার হাতে।
লোকটা ডিকশনারী মন্টুর হাতে তুলে দিল। মন্টু পাতা উল্টে বলল, বলুন তো Meed মানে কি?
মীড শব্দটার মানে হল পারিশ্রমিক।
গুড, হয়েছে। এখন বলুন ম্যালানিন মানে কি?
ম্যালানিন হচ্ছে কৃষ্ণকায় জাতির চুলের ও ত্বকের কৃষ্ণবর্ণ।
ভেরী গুড। এবার বলুন শেরাটন মানে কি?
শেরাটন হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর আসবাবপত্রের অনাড়ম্বর নির্মাণশৈলী।
হয়েছে। আমি তো জানতাম শেরাটন হোটেলের নাম। ব্রাদার আপনি তো কাবিল আদমী।
কাবিল আদমী ব্যাপারটা কি?
কাবিল আদমী হল গ্রেটম্যান। আপনার বয়স অল্প। আরেকটু বেশী বয়স হলে আপনার পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলতাম। অনেস্ট। আপনি তো ব্রাদার সুপারম্যান। আসুন এই গাছটার নীচে বসি। ব্রাদারলি কিছু কথাবার্তা বলি।
দুজনে গাছের নীচে বসল। মন্টু বলল, সঙ্গে চা থাকলে ভাল হত। গাছের নীচে বসে চা খেতাম। গ্রেট মিসটেক হয়ে গেছে।
লোকটা বলল, আপনি কি আমাকে এখানে রেখে যেতে এসেছেন?
আরে না। কি যে বলেন। আপনাকে খামাখা এখানে রেখে যাব কেন? আপনি বিড়াল হলেও একটা কথা ছিল। আমি আবার বিড়াল ফেলে দিয়ে আসার ব্যাপারে এক্সপার্ট। বিড়াল কিভাবে ফেলে দিয়ে আসতে হয় জানেন?
না।
একটা বস্তায় ভরতে হয়। বস্তার ভিতর নিতে হয় কপূর। যাতে কপূরের গন্ধে অন্য সব গন্ধ ঢাকা পড়ে যায়। অনেক দূরে নিয়ে বস্তার মুখ খুলতে হয়। বস্তার মুখ খুলবার আগে বস্তাটা ঝ ঝ করে ঘুরাতে হয় যাতে বিড়ালের দিকভ্রম হয়।
অনেক কায়দাকানুন দেখি।
হ্যাঁ অনেক। তারপরেও বিড়াল গন্ধ শুকে কে বাসায় চলে আসে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করে ডাকে। মনটা খুব খারাপ হয় ভাইসাব। আহা! বেচারা কতদূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে এসেছে। মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। আবার বস্তায় ভরে ফেলে দিয়ে আসতে হয় আরো দূরে। আবারো চলে আসে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করে।
লোকটি নীচু গলায় বলল, বিড়াল মিউ মিউ করে যে কথাগুলি বলে তা যদি মানুষ বুঝতো তাহলে তাকে কোনদিন ফেলে দিয়ে আসতো না।
বিড়াল কি বলে?
বিড়াল কাঁদতে কাঁদতে বলে, তুমি আমাকে অনেক দূরে ফেলে দিয়ে এসেছিলে। আশ্রয় এবং খাদ্যের সন্ধানে আমি অন্য কোথাও যেতে পারতাম। তা যাইনি। তোমার কাছেই ফিরে এসেছি। অনেক কষ্টে ফিরেছি। কেন জান? তোমার প্রতি ভালবাসার জন্যে। এই ভালবাসা পশুর ভালবাসা হলেও ভালবাসা। এর অমর্যাদা করো না। তুমি আমাকে গ্রহণ কর।
আপনাকে এসব কে বলেছে?
কেউ বলেনি। আমি অনুমান করেছি।
ভাই এই দেখেন আমার চোখে পানি এসে গেছে। আমি আবার হাইলি ইমোশনাল লোক। অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়। টিভির বাংলা সিনেমা যতবার দেখি ততবার কাঁদি। সবাই হাসাহাসি করে। সিনেমা দেখা ছেড়ে দিলাম এই কারণে।
মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা।