তাই নাকি?
হ্যাঁ। একবার কয়েকগাছি চুড়ি পরে এসেছিল, চুড়িগুলো গায়ের রঙের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেল যে কোনগুলো চুড়ি বোঝা যাচ্ছিল না।
বল কী।
তবে মেয়েটা দেখতে ভালোনা। মেয়েটার দিকে তাকালে মনটা খারাপ হয়ে যায়। এতো সুন্দর গায়ের রঙ, এতো সুন্দর শরীর।
বলতে-বলতে তরু লজ্জা পেয়ে গেল। সুন্দর শরীর কথাটা বলা ঠিক হয় নি, জহির ভাই কী মনে করলেন কে জানে।
জহির ভাই।
বল।
সবারই তো একইরকম নাক-মুখচোখ, তবু কাউকে সুন্দর লাগে, কাউকে লাগে না কেন?
কি জানি কেন।
তরু ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি নিজে দেখতে তো ভালো না এইজন্যে এটা নিয়ে আমি খুব ভাবি।
তুমি দেখতে খারাপ কে বলল?
খারাপ না তবে সাধারণ। খুব সাধারণ।
সাধারণই ভালো।
ছেলেদের জন্যে ভালো। মেয়েদের জন্যে না। একটা মেয়ের কেমন বিয়ে হবে, কী রকম বর হবে তা নির্ভর করে মেয়েটা দেখতে কেমন। মেয়েটি বুদ্ধিমতী কি-না, পড়াশুনায় কেমন, তার মনটা কেমন এইসব দেখা হবে না।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, তুমি কি বিয়ে নিয়ে খুব ভাব?
ভাবি। আপার এ কাণ্ডের পর ভাবি। নিজের চেহারাটা আরেকটু ভালো হলে তেমন ভাবতাম না।
তোমার চেহারা খারাপ না।
তা ঠিক। খারাপ না, তবে ভালো না।
তরু হাত থেকে আংটি খুলে বাক্সে ভরতে-ভরতে বলল, বাবা বলছিলেন আজকে যে মেয়েটিকে দেখতে যাবেন সে খুব সুন্দর তবে রোগা। জহির কিছু বলল না। তরু বলল, ওদের নাকি খুব আগ্রহ। আগের কয়েকটা বিয়ে লাগানী-ভাঙানীর জন্যে ভেঙে গেছে তাই…. তরু কথা শেষ না করে উঠে গেল।
জহির ঘড়ি দেখল। চারটা চল্লিশ; অথচ বাইরে এখনো কড়া রোদ। আকাশে মেঘের ছিটাফোঁটাও নেই। সে ভেতরের বারান্দায় এল। দুটো গোলাপ গাছে অসুখ ধরেছে। পাতা কুঁকড়ে যাচ্ছে। গাছের কষ্টটা দেখেই বোঝা যায়। গোলাপের এই অসুখটা খুব খারাপ। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কাল-পরশুর মধ্যে ওষুধ এনে দিতে হবে। জহির গাছগুলোর কাছে নেমে এল। অসুস্থ পাতাগুলো ফেলে দিতে হবে। গাছের গোড়ায় কিছু ছাই দিতে পারলে হত। শহরে ছাই কোথায় পাওয়া যাবে।
তরু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে সে কিছু বলতে চায়। জহির বলল, কিছু বলবে তরু?
না।
তোমার মনটা খুব খারাপ বলে মনে হচ্ছে। কিছু হয়েছে?
না মাথা ধরেছে।
চোখ বন্ধ করে ঘরটা অন্ধকার করে শুয়ে থাক।
আপনার এই হলুদ রঙের শার্টটা দেখলেই আমার মাথা ধরে যায়। একদিন আপনার বাসায় গিয়ে শার্টটা পুড়িয়ে দিয়ে আসব। হাসবেন না, সত্যি-সত্যি পুড়িয়ে দেব কিন্তু। জহির দেখল তরু মুখ থেকে বিষণ্ণ ভাবটা চলে গেছে। সে হাসছে। হাসলে এই মেয়েটাকে সুন্দর দেখায়। হাসলে সবাইকে সুন্দর দেখায় কিন্তু এই মেয়েটিকে একটু বেশি সুন্দর লাগে।
এ বাড়ির মানুষেরা কথা কম বলে। শুধু শাহানা কিছু বেশি কথা বলেন। তরু, অরু এবং মীরু এই তিন বোন তো কথাই বলে না। বনেরা মিলে গল্প করার দৃশ্যও জহির খুব বেশি দেখে নি তবে এই তিন বোনর মধ্যে তরু খানিকটা সহজ। বাইরের লোকজন এলে সে এগিয়ে গিয়ে গল্প করে। তাও অবশ্যি অল্প কিছুক্ষণ। মনে হয়। কিছুক্ষণ গল্প করার পরই তার আগ্রহ নিভে যায়। তরু নরম গলায় বলল, জহির ভাই?
বল।
অসুন্দর মেয়ে হবার সবচে বড় সমস্যা কি জানেন?
না।
একটা অসুন্দর মেয়ে যদি কাউকে পছন্দ করে সে তা জানাবার সাহস পায় না। মনের মধ্যে চেপে রাখতে হয়।
এইসব আজেবাজে জিনিস নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয়? যাও আমার জন্যে চা বানিয়ে আন।
শাহানার ঘুম ভাল।
ঘুম ভাঙলে প্রথম তিনি যে কাজটি করেন তা হচ্ছে মতির মাকে বকাঝকা। আজ বকাঝকা চূড়ান্ত রকমের হতে পারে। মতির মারও ঘুম ভেঙেছে। সে এই বকাঝকা মোটও গ্রাহ্য করল না। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বলল, আফা দেহি আমারে একফোঁটা চা দেন।
জহিরের চা খাওয়া শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বরকত সাহেব ঢুকলেন। আজ কেন জানি তাঁকে ক্লান্ত ও বিরক্ত লাগছে। তিনি জহিরকে দেখে বললেন, এসে পড়েছ? মেয়ের এক বড় খালু আমার কাছে এসেছিলেন। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পর যেতে। রাতে ঐ বাড়িতে খেতে বলেছে। খাওয়াটা কি ঠিক হবে? চা-মিষ্টি খাওয়া এক জিনিস আর ভাত খাওয়া অন্য জিনিস। আমি অবশ্যি হ্যাঁ-না কিছুই বলি নি। খাওয়াতে চাচ্ছে খাওয়াক। তুমি কী বল?
আপনি যা ভালো মনে করেন।
এরেঞ্জড্ ম্যারেজ এখন ভয়ঙ্কর সমস্যা। ছেলেগুলোর চরিত্রের ঠিক নাই, মেয়েগুলোও তেমন। বিরাট টেনশান। তরুর একটা বিয়ে কোনো মতে দিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিত হই।
এখনই তরুর বিয়ে?
হ্যাঁ, এখনই। তুমি জান না বখা ছেলেগুলো খুব যন্ত্রণা করছে। তরু তোমাকে কিছু বলে নি?
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, না তো!
লজ্জায় বলে নি। বলার মতো জিনিস তো না। তুমি আবার নিজ থেকে জিজ্ঞেস করো না–লজ্জা পাবে।
না আমি কিছুই জিজ্ঞেস করব না।
জহিরের মন খারাপ হল। বেশ মন খারাপ। সে তরুকে পছন্দ করে। অনেকখানিই করে। এই মেয়েটা মনে কষ্ট নিয়ে ঘুরছে ভাবতেই খারাপ লাগে। কি করেছে। ছেলেগুলো? খারাপ কোন গালাগাল দিয়েছে? নাকি গায়ে হাত-টাত দিয়েছে?
সারাদিন ঝাঁ-ঝাঁ রোদ ছিল
সারাদিন ঝাঁ-ঝাঁ রোদ ছিল। অথচ সন্ধ্যা মেলাবার আগেই মেঘ জমে আকাশ কালো হয়ে গেল। বরকত সাহেব জহিরকে নিয়ে রাস্তায় নামতেই ফোঁটা-ফোঁটা বৃষ্টি পড়তে লাগল। বরকত সাহেব বললেন, বৃষ্টি হলে বাঁচা যায়, কি বল জহির?