ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে একবার কায়দা করে বললেন, জহির, অরুকে বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। একজন ছেলেও মোটামুটি পছন্দ হয়েছে ডাক্তার ছেলে।
জহির ভাত খাচ্ছিল, মুখ না তুলেই বলল, তাহলে তো ভালোই হয় মামী।
শিগগিরই বিয়েটা দিয়ে দেব, তোমার অনেক খাটাখাটনি আছে।
জহির কিছু বলল না। যে ভাবে খাচ্ছিল সেই ভাবেই খেয়ে চলল। শাহানার এই লক্ষণ ভালো লাগল না। তাছাড়া তাঁর কাছে মনে হল কথা শুনে জহির একটু মনমরা হয়ে গেছে। খাওয়া শেষ করে সে সেদিন আর অপেক্ষা করল না। অন্যদিন বেশ কিছুক্ষণ থাকে। শাহানার বুক কাঁপতে লাগল। সেই রাতে তাঁর ঘুম ভালো হল না।
তাঁর দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। এই ঘটনার পনের দিনের মাথায় অরু কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলল। তাদের লালমাটিয়া কলেজের ইতিহাসের একজন টিচারকে বিয়ে হল বরিশালে। অরু মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল থেকে চিঠি লিখে সব জানাল।
ইতিহাসের ঐ শিক্ষকের নাম আজহার হোসেন। ভদ্রলোক বিবাহিত, বয়স চল্লিশের ওপর। তাঁর বড় ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। ভদ্রলোকের স্ত্রীর সুন্দর মিগ্ধ চেহারা। এই সুন্দর স্নিগ্ধ চেহারার মেয়েটি অরুদের বাসায় এসে কঠিন গলায় এমনসব কথা বলতে লাগলেন যে শাহানার ইচ্ছা করল নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জা, কী লজ্জা!
অরু এখন ঢাকাতেই আছে। তার ডাক্তারী পড়া বন্ধ। সে একটা কিন্ডারগার্টেনে মাস্টারি করে এবং আজাহার হোসেনের সঙ্গে জীবনযাপন করে। সেই জীবন কেমন এ বাড়ির কেউ জানে না। অরুর সঙ্গে এদের কোনো যোগাযোগ নেই। এ বাড়িতে অরুর ব্যবহারী প্রতিটি জিনিস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। শাহানাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, আপনার ছেলেমেয়ে কি? তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আমার দুই মেয়ে। এটা বলতে তাঁর কথা আটকে যায় না বা তিনি কোনোকষ্টবোধ করেন না। কিংবা কে জানে, হয়ত করেন, কাউকে বুঝতে দেন না। গত ঈদে অরু এসেছিল। শাহানা রাগে কাঁপতে-কাঁপতে বলেছিলেন, তোর এত সাহস! তুই এ বাড়িতে আসতে পারলি? এক্ষুনি বের হ। এক্ষুনি। অরু চলে গিয়েছিল এবং আর কখনো আসে নি।
শাহানার ধারণা জহিরের সঙ্গে অরুর হয়ত কোনোযোগাযোগ আছে। এই বিষয়ে জহিরকে তিনি কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আজকাল মাঝে-মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে।
তরুর অস্থির ভাবটা আরো বাড়ল।
জহির ভাই এখনো বের হচ্ছেন না। কী করছেন তিনি? চা খাচ্ছেন? ককাপ চা? এই ঝাঁঝাঁ দুপুরে চা খাবার দরকারটা কি? তার ইচ্ছা করছে উঁকি দিয়ে দেখতে। ইচ্ছা করলেও যাওয়া যাবে না। সবাই ঘুমুচ্ছে। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করবে কে? তরু বসার ঘরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। তার তখনি চোখে পড়ল জহির ভাই বেরুচ্ছেন। আজ তাকে অন্যরকম লাগছে। কেন অন্যরকম লাগছে? গায়ে তো সেই পুরনো হলুদ শার্ট। এরকম বিশ্রী রঙের শার্ট কেউ পরে? কপয়সা আর লাগে ভালো একটা শার্ট কিনতে। কত সুন্দর-সুন্দর শার্ট আজকাল বের হয়েছে!
জহির কলিং বেলে হাত দেয়ার আগেই জানালার ওপাশ থেকে তরু বলল, জহির ভাই।
জহির জানালার পাশে এগিয়ে এসে বলল, তুমি কলেজে যাও নাই?
না। আপনি ঐ চায়ের দোকানে বসে কী করছিলেন?
দেখেছ নাকি?
হাঁ দেখেছি। আপনি ওখানে কী করছিলেন?
চা খাচ্ছিলাম, আবার কি?
এ বাড়িতে আমরা কি চা বানাতে পারি না যে দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়?
জহির কথা ঘুরাবার জন্যে বলল, দরজা খোল তরু, জানালা দিয়ে কথা বলব?
তরু দরজা খুলল, তার মুখ ভার-ভার, বিষণ্ণ।
জহির বলল, কেউ নেই নাকি? ঘর এমন চুপচাপ। তরু করুণ গলায় বলল, এ বাড়ি এখন তো চুপচাপই থাকে। এ বাড়িতে হৈচৈ-এর মানুষ কোথায়? বসুন জহির ভাই। কেন জানি আপনাকে দেখে আজ খুব ভালো লাগছে। জহির লজ্জিত মুখে বলল, মামা এখনো ফেরেন নি?
উহুঁ। আপনাকে আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন জহির ভাই? কেমন অচেনা-অচেনা লাগছে।
চুল কেটেছি।
আপনাদের পুরুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, দুই দিন পরপর চুল কাটেন আর চেহারাটা বদলে যায়।
মানুষ তো আর বদলায় না।
কে জানে হয়ত বদলায়।
তোমার মনটা মনে হয় খারাপ। কিছু হয়েছে নাকি?
না, কি আর হবে।
মামী কোথায়?
ঘুমুচ্ছেন। ডাকব?
না, ডাকার দরকার নেই।
জহির খানিক ইতস্তত করে বলল, জিনিসটা কেমন দেখ তো তরু। এনগেজমেন্টের একটা আংটি কিনলাম। মানে মামা বললেন—তাই।
তরু হাত বাড়িয়ে আংটির বাক্সটি নিল। জহিরের অসময়ে আসার উদ্দেশ্য তার মনে পড়ল। আজ যোল তারিখ, মেয়ে দেখার দিন; তরুর মনেই ছিল না।
জহির নিচু গলায় বলল, তোমাকে নিয়ে কিনতে চেয়েছিলাম, ভাবলাম তোমাকে নিয়ে গেলে তুমি শুধু দামিগুলো কিনতে চাইবে। মানে আমার তো আবার
আংটিটা সুন্দর হয়েছে।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি। খুব সুন্দর।
আঙুলে লাগবে কি-না কে জানে।
লাগবে। জহির ভাই আমি একটু পরে দেখব?
পর। দেখ আবার যেন দাগ না লাগে।
তরু একদৃষ্টিতে কিছুক্ষণ জহিরের দিকে তাকিয়ে আংটি পরল। জহির বলল, লেগেছে?
হ্যাঁ।
টাইট হয় নি তো?।
না।
অবশ্যি হলেও অসুবিধা হবে না। ওরা বলেছে ফেরত নিবে। আংটিটা এখন খুলে ফেল তরু, ঘষাটসা লাগলে দাগ পড়ে যাবে।
পড়বে না। সোনাতে অত সহজে দাগ পড়ে না। চা খাবেন জহির ভাই।
না।
ঠাণ্ডা কিছু দেব? শরবত করে দেই, লেবু আছে।
না না কিছু লাগবে না। তুমি বস তো।
তরু তার সামনে বসল। নিচু গলায় বলল, আংটিটা আমাকে একদম মানাচ্ছে না, তাই না জহির ভাই? গায়ের রঙ আরো ফর্সা হলে মানাতো। যার গায়ের রঙ সোনার মতো তাকেই সোনার গয়নায় মানায়। আমাদের কলেজে সায়েন্স গ্রুপে একটা মেয়ে পড়ে, তার গায়ের রঙ অবিকল কাঁচা সোনার মতো।