বন্ধুর সঙ্গে আছে বাধ্য হয়ে, আমরা ওর আত্মীয়। আমরা ওর সুবিধা-অসুবিধা দেখব না?
এ রকম লয়-পাতায় আত্মীয় দেখলে তো চলে না।
কেন চলবে না?
মেয়ে বড় হয়েছে, একটা পুরুষ মানুষ হুট-হুট করে ঘুরবে, তা কি সম্ভব?
পুরুষ মানুষ কি বাঘ নাকি যে বড় মেয়ে দেখলেই চিবিয়ে গিলে ফেলবে?
তুই কেন শুধু-শুধু ঝগড়া করিস? তোর সমস্যাটা কি?
আমার কোনো সমস্যা নেই, এর পরে যখন ছেলেটা আসবে তখন তাকে বলবে এ বাড়িতে থাকতে।
আচ্ছা বলব।
জহির থাকতে রাজি হল না। এই ব্যাপারটা শাহানাকে বিস্মিত করল। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন বলামাত্র সে বিছানা-বালিশ নিয়ে চলে আসবে। শাহানা যখন আসতে বললেন, তখন সে লাজুক ভঙ্গিতে বলল, খুব বিপদে পড়লে তো আসতেই হবে। না এসে যাব কোথায়। আত্মীয় বলতে তত এক আপনারাই আছেন।
শাহানা বললেন, বলা রইল, অসুবিধা মনে করলে আসবে।
জ্বি আচ্ছা। ছুটির দিন চলে আসবে। খাওয়াদাওয়া করবে।
জ্বি আচ্ছা।
চাকরিবারির কোন সুবিধা হল?
খোঁজ করছি। তবে দুটা টিউশানি জোগাড় করেছি।
বল কী। এর মধ্যে টিউশানিও জোগাড় করে ফেলেছ?
আমার বন্ধু জোগাড় করে দিয়েছে।
একদিন তোমার বন্ধুকে নিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা।
আরেকটা কথা বলে রাখি, ঐ দিকের ছোট ঘরটায় আমার বড় মেয়ে থাকে। ওর মেজাজ-টেজাজ খুব খারাপ, তুমি যেন আবার হুট করে ওর ঘরে ঢুকবে না।
জ্বি না, ঢুকব না। মেজাজ খারাপ কেন?
জানি না। মেজাজের যন্ত্রণায় আমরা অস্থির। আরেকটা কথা, ঐদিন শুনলাম মীরুর সঙ্গে তুমি তুই-তুই করে কথা বলেছ। গ্রামের ছেলেরা বাচ্চাদের সঙ্গে তুই-তুই করে কথা বলে, তা আমি জানি। তুমি এটা করবে না।
জ্বি আচ্ছা।
জহির প্রতি শুক্রবারে আসতে শুরু করল। খুব সকালে আসে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যাবেলা চলে যায়। ছুটির দিনে বাইরের একটা মানুষ যে এসে সারাদিন থাকে এটা বোঝাই যায় না। পুরোপুরি নিঃশব্দ একটা মানুষ। বসার ঘরে চুপচাপ বসে আছে কিংবা বারান্দায় মোড়াতে মাথা নিচু করে তাকিয়ে আছে উঠানের ঘাসে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবেজিজ্ঞেস না করলে মুখ তালাবন্ধ। একদিন দেখা গেল একটা খুরপি কিনে এনেছে। উঠানের ঘাস তুলে কী যেন করা হচ্ছে। শাহানা বলল করছ কী তুমি?
কিছু না মামী। মাটি কোপাচ্ছ কেন?
কয়েকটা গাছ লাগিয়ে দিচ্ছি। গাছপালা নেই, জায়গাটা কেমন ন্যাড়া-ন্যাড়া লাগে।
পরের বাড়িতে গাছপালা লাগিয়ে লাভ নেই। তুমি এসব রাখ তো।
জ্বি আচ্ছা।
রেশন এনে দাও। পারবে তো আনতে?
জ্বি পারব।
ছুটির দিনে ছোটখাটো কাজের ভারগুলো আস্তে আস্তে তুলে রাখা হতে থাকে জহিরের জন্যে। এইসব কাজের ফাঁকে-ফাঁকে দেখা যায় একচিলতে উঠানের বিভিন্ন জায়গায় ছোটখাটো গাছ, গাছগুলোও জহিরের মতোই প্রায় অদৃশ্য। এরা যে আছে তাই বোঝা যায় না। তারপর একদিন বোগেনভেলিয়ার লতানো গাছ ছাদে উঠে গাঢ় কমলা রঙের পাতা ছেড়ে দিল। দক্ষিণের উঠানের কোনার দিকের গোলাপ গাছগুলো অবশ্যি আরো আগেই গোলাপ ফুটাতে শুরু করেছে।
দুবছরের মাথায় জহিরের একটা চাকরিও হয়ে গেল। বড় এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে একদিন এসে মামা-মামীকে সালাম করল। বরকত সাহেব বললেন, চাকরি জোগাড় করে ফেলেছ? ভালো। খুব ভালো। তুমি দেখি অসাধ্য সাধন করলে।
তেমন কিছু না। প্রাইভেট ফার্ম।
প্রাইভেট ফার্মই ভালো। সরকারি চাকরি আর কজন পায় বল? খুশি হয়েছি। আমি খুব খুশি হয়েছি। এইবার বাসা ভাড়া করে টাকাপয়সা জমাও। বিয়েটিয়ে কর। সারাজীবন কষ্ট করেছ। এখন সুখ পাও কি-না দেখা
জহিরের চোখে পানি এসে গেল। সে ধরা গলায় বলল, আপনার এখানে যে আদর পেয়েছি এই কথা আমি সারাজীবন ভুলব না মামা।
বরকত সাহেব খুবই অবাক হয়ে গেলেন, কী ধরনের আদর এই ছেলেকে করা হয়েছে তা বুঝতে পারলেন না। খানিকটা লজ্জিত বোধ করতে লাগলেন।
চাকরি পাওয়ার পর জহিরের এ বাড়িতে আসা-যাওয়ার পরিমাণ কিছু বাড়ল। ছুটির দিন ছাড়াও তাকে দেখা যেতে লাগল; হাতে নানান টুকিটাকি, যেমন একটা বেতের মোড়া, কারণ আগেরটা নষ্ট হয়ে গেছে। একটা হাতুড়ি, কারণ এ বাড়িতে হাতুড়ি নেই। এক বাভিল দড়ি। একবার এক চুনকামওয়ালা মিস্ত্রি ধরে আনল বাড়ি চুনকাম করে দেবে। শাহানা বিরক্ত হয়ে বললেন, পরের বাড়ি আমি নিজের পয়সায় চুনকাম করব কেন?
জহির লাজুক গলায় বলল, টাকাপয়সা নিয়ে চিন্তা করবেন না, মামী।
চিন্তা করব না মানে? টাকাপয়সা কে দেবে, তুমি?
জহির মাথা নিচু করে রইল। শাহানা তীব্র গলায় বললেন, তুমি টাকাপয়সা দেবে। কেন? কী অদ্ভুত কথা!
তাহলে মামী থাক। ওকে চলে যেতে বলি?।
হ্যাঁ বল।
শুধু অরুর ঘরটা চুনকাম করে দিক।
শাহানার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। জহির মৃদু স্বরে বলল, ও ঐদিন বলছিল তার ঘরের দেয়ালগুলো বড় নোংরা–তার নাকি ঘেন্না লাগে।
এই শুনেই তুমি চুনকামওয়ালা নিয়ে এসেছ? বল, ওকে চলে যেতে বল। এক্ষুনি যেতে বল।
জ্বি আচ্ছা।
শাহানার মনে অন্য একটা সন্দেহ দেখা দিল জহির যে এত ঘনঘন এখানে আসে তার মূল কারণ অরু নয় তো? কী সর্বনাশের কথা! বরকত সাহেবের সঙ্গে তিনি ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করলেন। বরকত সাহেব হেসে উড়িয়ে দিলেন।
কী যে তুমি বল। কোনদিন কথাই বলতে দেখলাম না।
এইখানে হয়ত বলে না কিন্তু বাইরে….
বাইরে কথা বলাবলির সুযোগ কোথায়? বাজে ব্যাপার নিয়ে তুমি চিন্তা করবে না।
শাহানা খুব ভরসা পান না। বাইরে দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পুরোপুরি বাদ দেওয়া যায় না। অরুবরিশাল মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছে। তাকে বরিশালে আনা- নেয়ার দায়িত্ব পালন করে জহির। তখন কি তাদের কোনো কথাবার্তা হয় না? গ্রামের এইসব মিনমিনে ধরনের ছেলে ভেতরে খুব সজাগ। কী চাল চলছে কে জানে? তাছাড়া তিনি লক্ষ করেছেন, জহির শুধু যে মীরুর সঙ্গে তুই-তুই করে বলে তাই না, তরুর সঙ্গেও বলে। এইসব আলাপে গভীর অন্তরঙ্গতার ছোঁয়া থাকে। এতে কিসের খাতির।