শাহানা বললেন, গ্রামের এইসব মূৰ্খ ছেলে, এদের সরাসরি না বললে কিছুই বুঝবে না। ভাত খাওয়াতে চাচ্ছ খাওয়াও তারপর বিশটা টাকা হাতে ধরিয়ে বিদেয় করে দাও।
এতরাতে যাবে কোথায়?
রাত এমন কিছু বেশি হয় নি। কত বড় গাধা, বি. এ. পাস করে ভাবছে লোকজন চাকরি নিয়ে তার জন্যে বসে আছে। এদের উচিত শিক্ষা হওয়া উচিত। লতায়-পাতায় সম্পর্ক ধরে উঠে পড়ছে। এদের কি কাণ্ডজ্ঞানও নেই?
রাতটা থাকুক। সকালে বুঝিয়ে বলব। বিপদে পড়েই তো আসে। আত্মীয়তার দাবি নিয়ে এসেছে।
শাহানা অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তাঁর বিরক্তির কারণও ছিল। গত মাসেই একজন এসে দশ দিন থেকে গেছে। ফিরে যাবার ভাড়া পর্যন্ত ছিল না। পঞ্চাশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিয়ে করতে হয়েছে। তার আগের মাসে দুজন এসেছিল চিকিৎসার জন্যে। তারা থেকেছে এগার দিন। তাদের অসুখ সারে নি। চিঠি দিয়েছে—আবার আসবে।
বরকত সাহেব হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন। আবেগহীন গলায় বললেন, কাপড়-চোপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া কর। সকালে কথা হবে।
জহির বলল, মামা আমি তো এখানে কিছু খাব না।
খাবে না কেন?
আমাদের শ্যামগঞ্জের একটা ছেলে থাকে নাজিমুদ্দিন রোডের একটা মেসে। তাকে বলে এসেছি তার সঙ্গে খাব। ও অপেক্ষা করবে।
ও আচ্ছা।
আমি তাহলে মামা এখন উঠি।
উঠবে মানে। তুমি কি ঐ মেসেই উঠবে নাকি?
জ্বি। আগে চিঠি দিয়ে রেখেছিলাম।
মেসে উঠতে চাও উঠবে। স্বাধীনভাবে থাকার একটা সুবিধা আছে। বাড়িতে সেই সুবিধা নেই। বাড়তি একটা লোক রাখার মতো অবস্থাও আমার নেই। তা না হলে…..।
বরকত সাহেব কথা শেষ করলেন না। কী বলবেন গুছিয়ে উঠতে পারলেন না। এখন খানিকটা লজ্জিতও বোধ করছেন।
জহির বলল, মামীকে একটু সালাম করে যাই। উনার সঙ্গে দেখা হয় নাই কখনো।
শাহানার মুখে অপ্ৰসন্ন ভাব এখন আর নেই। তিনি বেশ আন্তরিক সুরেই বললেন, এত রাতে না খেয়ে যাবে সেটা কেমন কথা। যা আছে খেয়ে যাও।
আরেকদিন এসে খাব। আমি আমার এই সুটকেসটা রেখে যাই, কিছু দরকারি। কাগজপত্র আছে। মেসে রাখা ঠিক না। বাচ্চাগুলোর জন্যে সামান্য মিষ্টি এনেছিলাম। পাসের মিষ্টি, বি. এ. পাস করেছি। সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি মামী।
বাহ্ ভালো তো। মিষ্টি আনার কোনো দরকার ছিল না।
কী যে বলেন, মামী। আত্মীয় বলে তো আপনারাই আছেন। আর তো কেউ নাই। বড় ভালো লাগল।
বরকত সাহেব বললেন, এই শীতে একটা শার্ট গায়ে দিয়ে আছ। ঠাণ্ডা লাগছে না?
জহির লজ্জিত গলায় বলল, শার্টের নিচে সুয়েটার আছে মামা। একটু ঘেঁড়া, এই জন্যে ভেতরে পরেছি। তাছাড়া মামা ঢাকা শহরে শীত একেবারেই নাই।
রাতে খাবার টেবিলে বরকত সাহেব গম্ভীর হয়ে রইলেন। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে নিচু গলায় বললেন, বেচারা দেখা করতে এসেছিল আর কত কথাই না তুমি বললে। ছিঃ ছিঃ। শাহানা কঠিন গলায় বললেন, কঠিন কথা আমি কী বললাম? যা, সত্যি তাই বলেছি। একেকজন আসে আর সিন্দাবাদের ভূতের মতো চেপে বসে, তোমার মনে থাকে না?
সবাই তো একরকম না।
সবাই একরকম। তোমার জহিরও আলাদা কিছু না। দুদিন পরে টাকাপয়সা ফুরিয়ে যাবে; এসে তোমার ওপর ভর করবে।
নাও তো করতে পারে।
সুটকেস রেখে গেছে কী জন্যে তাও বোঝ না? রেখে গেছে যাতে সহজে আবার ঢুকতে পারে। সুটকেস রেখে যাবার তার দরকারটা কী? কোন কোহিনূর হীরা তার সুটকেসে আছে যে সুটকেস রেখে যেতে হবে?
তুমি সব কিছু বড় বেশি বোঝ।
বেশি বোঝাটা কি অন্যায়?
হ্যাঁ অন্যায়। যতটুকু বোঝার ততটুকুই বুঝতে হয়। তার বেশি না।
শাহানা কঠিন চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়লেন। তরুর বড় বোন অরু তখন ক্লান্ত গলায় বলল, তোমরা কী শুরু করলে? রোজ ঝগড়া, বড় খারাপ লাগে।
শাহানা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, খারাপ লাগলে এই বাড়িতে পড়ে আছিস কেন, চলে যা। অরু বলল, তাই যাব মা। সত্যি-সত্যি যাব।
অরু তখন কলেজে পড়ে। লালমাটিয়া কলেজে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রী। সব সময় বিষণ্ণ হয়ে থাকে। এই বিষণ্ণতার কোনো কারণ কেউ জানে না। অরুর স্বভাব অসম্ভব চাপা। তার চরিত্রের মধ্যেও কিছু অস্বাভাবিকতা আছে। কলেজে যাবার জন্যে তৈরি হয়েছে। গেট পর্যন্ত গিয়ে হঠাৎ ফিরে এল। শান্ত গলায় বলল, আজ কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে। না মা।
শাহানা চিন্তিত হয়ে বললেন, শরীর খারাপ নাকি?
না শরীর ঠিক আছে।
অরু নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এই দরজা সারাদিনেও খোলা হল না। অরুর তখন নিজের একটা ঘর হয়েছে। স্টোর রুমটাকেই সে ঘর বানিয়ে নিয়েছে। পায়রার খুপরির মত একটা ঘর। ছোট্ট একটা জানালা। না আছে আলো, না আছে। বাতাস। তবু সে এই ঘরেই আছে। এইটাই তার ভালো লাগে।
শাহানা পৃথিবীর কাউকেই পরোয়া করেন না কিন্তু কোনো বিচিত্র কারণে বড় মেয়েকে সমীহ করেন, অনেকখানিই করেন। অরুর স্বভাবই হচ্ছে মা যে ব্যাপারটা পছন্দ করেন না, সে তাই করবে। শাহানা একদিন বললেন, রোজ শাড়ি পরে কলেজে যাস কেন, এখনো তো শাড়ি পরার বয়স হয় নি। যখন হয় তখন পরবি।
এখন পরলে অসুবিধা কি?
বড়-বড় দেখায়।
বড়-বড় দেখালে অসুবিধা কি?
তুই বড় যন্ত্ৰণা করিস অরু।
তুমিও বড় যন্ত্রণা কর মা।
অরু সেদিন থেকেই পুরোপুরি শাড়ি পরা শুরু করল। নতুন একটা কামিজ বানানো হয়েছে। একদিনমাত্র পরা হয়েছে; ঐটিও সে ছুঁয়ে দেখবে না।
শাহানা জহিরকে এ বাড়িতে রাখবেন না, শুধুমাত্র এই কারণে অরু উঠে-পড়ে লাগল যেন জহির এ বাড়িতে থাকে। শাহানা অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, ওর থাকার জায়গা আছে। বন্ধুর সঙ্গে উঠেছে, ওকে জোর করে এখানে আনতে হবে?