আদরে-আদরে মীরুর অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে বলে তরুর ধারণা। মীরু অসম্ভব জেদী এবং রাগী হয়েছে। একবার রাগ করে দুদিন ভাত না খেয়ে ছিল। তারচেয়েও সমস্যার কথা ইদানীং তার বোধহয় কোনো একটা ছেলের সঙ্গে ভাব হয়েছে। সেই ছেলের লেখা একটা কাঁচা প্রেমপত্র তরু উদ্ধার করেছিল। মাকে তা দেখাতেই তিনি বললেন, ওর দোষ কী বল? জোর করে দিয়ে দেয়। ছেলেগুলো হচ্ছে বদের হাড্ডি। তরু অবাক হয়ে বলল, তুমি মীরুকে কিছু বলবে না?
বলব ধীরেসুস্থে বলব। এত তাড়াহুড়ার কী? কিছু বলব তারপর দেখবি রাগ করে। ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেবে। আরেক যন্ত্রণা।
শাহানা কিছুই বলেন নি। মীরুর কোনো অপরাধ তাঁর চোখে পড়ে না। কোনোদিন হয়ত পড়বেও না। এবং একদিন দেখা যাবে মীরু একটা কাণ্ড করে বসেছে।
তরু নিজের ঘর থেকে বের হয়ে পাশের ঘরে উঁকি দিল। এই ঘরটা আপাতত ফাঁকা। দেশের বাড়ি থেকে কেউ এলে থাকে। এখন মতির মা শুয়ে আছে। এই ঘরেও ফ্যান আছে। ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পিডে তবু মতির মার হাতে একটা পাখা। ঘুমের মধ্যেই সে তালের পাখা নাড়ছে। তরু ডাকল, এই মতির মা। মতির মা।
মতির মা সঙ্গে-সঙ্গে বলল, কি আফা?
একটু দেখে আস তো চায়ের দোকানটায় জহির ভাই বসে আছেন কি না।
আচ্ছা আফা।
বলেই মতির মা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। মতির মাকে হাজার ডাকাডাকি করেও লাভ হবে না। সে ঠিকই সাড়া দেবে তারপর আড্ডা বলে আবার ঘুমিয়ে পড়বে।
তরু বসার ঘরে চলে এল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। জহির ভাই কি চলে গেল নাকি? হঠাৎ তরুর চোখে পানি এসে গেল। ব্যাপারটা এত হঠাৎ হল যে সে লজ্জায় অস্থির হয়ে পড়ল। জহির ভাইকে সে খুব পছন্দ করে তা ঠিক। কিন্তু তার মানে এই না যে তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি আসতে হবে। ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার। ভাগ্যিস কেউ দেখে ফেলে নি।
জহিরকে সে প্রথম দেখে পাঁচ বছর আগে। সে তখন ক্লাস এইটে পড়ে। কী কারণে যেন দুই পিরিয়ড পরেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। সে বাসায় এসে গল্পের বই নিয়ে বসেছে, তার কিছুক্ষণ পরেই জহির এসে উপস্থিত। হাতে একটা চামড়ার সুটকেস, সঙ্গে সতরঞ্জির একটা বিছানা। তার গায়ে হলুদ রঙের শার্ট। গলায় কটকটে লাল রঙের মাফলার। তরু বলল, কাকে চান?
লোকটি একটু টেনে-টেনে বলল, এটা বরকত সাহেবের বাসা?
জ্বি।
উনাকে একটু ডেকে দেবেন? আমি শ্যামগঞ্জ থেকে আসছি।
আব্বা তো অফিসে।
অফিসে? কখন আসবেন?
পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার সময়।
আচ্ছা তাহলে যাই। স্লামালিকুম।
লোকটা তার মত একটা বাচ্চা মেয়েকে ম্লাস্লামালিকুম দিচ্ছে, কী আশ্চর্য। তরুর খুব মজা লাগল। সে বলল, আম্মা আছে, আম্মাকে ডেকে দেব?
না। উনি আমাকে চিনবেন না। আমি আসব সাড়ে পাঁচটার সময়। সুটকেসটা রেখে যাই?
ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় আবার এসে উপস্থিত। তরু বলল, বাবা এখনো আসেন নি।
মাঝে-মাঝে উনি তাস খেলতে যান তখন ফিরতে দেরি হয়।
কত দেরি হয়?
তার কোনো ঠিক নেই। কোনো কোনোদিন রাত আটটা নটাও বাজে।
আচ্ছা আমি তাহলে নয়টার সময় আসব।
বসুন না। এখানে বসে অপেক্ষা করুন। মাকে ডাকি?
উনি আমাকে চিনবেন না।
তরু হাসিমুখে বলল, আপনি আমাদের আত্মীয় হন?
হুঁ। সম্পর্কে তোমার ভাই হই।
তাই নাকি?
মামা, অর্থাৎ তোমার আব্ব চিনবেন। আমাদের আদিবাড়ি শ্যামগঞ্জের রসুলপুর। মিয়াবাড়ি। এক সময় খুব নামকরা বাড়ি ছিল। এখন অবশ্য গরীব অবস্থা।
গরীব অবস্থা যে তা অবশ্যি তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। শীতের কাপড় বলতে গলার লাল রঙের মাফলার। জানুয়ারি মাসের প্রচণ্ড শীত মানুষটা একটা মাফলার দিয়ে সামাল দিচ্ছে কীভাবে কে জানে। তরুর খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে, আপনার শীত লাগছে না? লজ্জায় জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। তরু বলল, বসুন না। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন?
জহির বসল তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বরকত সাহেব এসে পড়লেন। তাঁর বয়স তিপ্পান্ন, দেখাচ্ছে তার চেয়েও বেশি। তিনি ইস্টার্ন প্যাকেজিং লিমিটেডের এ. জি. এম.। এই কোম্পানির অবস্থা বেশ ভালো তবে কানাঘুষা শোনা যাচ্ছে মালিকানা হাত-বদল হবে। নতুন মালিক কিছু লোকজন সবসময় ছাঁটাই করেন। বরকত সাহেবের ধারণা তিনি এই ছাঁটাইয়ে পড়বেন। এইসব কারণে কদিন ধরেই তাঁর মন ভাল নেই। রোজ মুখ অন্ধকার করে বাড়ি ফেরেন। জহিরকে দেখে অপ্রসন্ন গলায় বললেন, তুমি? তুমি কোত্থেকে?
জহির কদমবুসি করতে-করতে বলল, এই বৎসর বি. এ. পাস করেছি মামা। চাকরির সন্ধানে এসেছি। এই কথায় বরকত সাহেবের মুখ আরো অন্ধকার হয়ে গেল।
চাকরির কোনো খোঁজ পেয়ে এসেছ না এখন খুঁজবে?
জ্বি এখন খুজব। মফস্বলে থেকে কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
বরকত সাহেবের মুখ কালো হয়ে গেল। তিনি শুকনো গলায় বললেন, বস আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি।
বি. এ-তে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি, মামা।
ভালো। খুব ভালো। চাকরির বাজারে অবশ্যি বি. এ, এম. এ. কোন কাজে লাগে। না, সব ধরাধরি। এসে ভুল করেছ।
বরকত সাহেব বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শাহানার সঙ্গে ছোটখাট একটা ঝগড়া বেঁধে গেল। শাহানা চাচ্ছেন যেন এই ছেলেকে এক্ষুনি বলা হয় এই বাড়িতে থেকে চাকরি খোঁজা সম্ভব না। প্রথমত থাকার জায়গা নেই। দ্বিতীয়ত এই বাজারে একটা বাড়তি লোক পোর প্রশ্নই ওঠে না।
বরকত সাহেব এইসব কথা এক্ষুনি বলতে চাচ্ছেন না। তিনি বললেন, রাতটা থাকুক, সকালে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বললেই হবে।