বাসে আসবার সময় পাঁচটা টাকা শুধু-শুধু চলে গেল। ভাংতি ছিল না বলে কন্ডাকটারকে পাঁচ টাকা দিয়েছে। কন্ডাকটার বলল, লামনের সময় লইবেন। ব্যাপারটা সারাক্ষণই মনে ছিল, অথচ সে নেমে গেল টাকা না নিয়েই। আজকের দিনে আরো কত অঘটন তার জন্যে অপেক্ষা করছে কে জানে। হয়ত মেয়ে দেখে পছন্দ করে আংটি দেবার সময় মেয়ে বলবে, না না, আমি আংটি পরব না। বিচিত্র কিছু না, এমন হতে পারে।
দ্বিতীয় মেয়েটির বেলায় ঠিক এই জিনিস হল। এই মেয়েটিকে সে দেখেছিল বাসাবোতে, তার ফুপার বাসায়। মেয়েকে দেখার আগেই সে তার ছবি দেখেছিল। ছবিতে সে ডোরাকাটা একটা শাড়ি পরে রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিল। হাসি-হাসি মুখ তবে চোখ দুটো বিষণ্ণ। বিয়ের পর এই মেয়ে তার পাশে-পাশে থাকবে, তাঁর বাসার রেলিং ধরে ঠিক এই ভঙ্গিতে দাঁড়াবে ভাবতেই কেমন যেন লাগে। জহিরের বাসায় রেলিং নেই, সে ছবি দেখার পর ঠিক করে ফেলেছিল বিয়ের পর রেলিং আছে এমন একটা বাড়িতে সে উঠে যাবে। ভাড়া যদি কিছু বেশি দিতে হয় দেবে। সবসময় টাকাপয়সার কথা ভাবলে তা হয় না।
মেয়েটিকে চাক্ষুষ দেখে তার অবশ্যি একটু মন খারাপ হয়েছিল। সে ছবির মতো সুন্দর না। তবু তাকে ভালো লাগল। জহিরের মনে হল এই মেয়ের মধ্যে মায়া ভাবটা খুব প্রবল। তার হাঁটা, কথা বলা সব কিছুর মধ্যে কোমল একটা ব্যাপার আছে। তাকে দেখে মনে হয় এই মেয়ে কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতে পারে না। তার সেই ক্ষমতাই নেই। অথচ এই মেয়েটিই কি না তাকে অপছন্দ করল। মেয়ের ফুপা জহিরের মামাকে বললেন, সবলতা ঠিকঠাকই ছিল তবে মেয়ে রাজি হচ্ছে না। খুব কান্নাকাটি করছে। মেয়ের মতের বিরুদ্ধে জোর করে কিছু করা ঠিক হবে না।
তার সঙ্গে বিয়ে হতে পারে এই সম্ভাবনাতে একটা মেয়ে খুব কান্নাকাটি করছে। এটা ভাবতেও মন ভেঙে যায়। কয়েক রাত জহির ঘুমুতে পারল না। সে কি এতই নগণ্য, এতই তুচ্ছ? সে একটা ছোট চাকরি করে। তাতে কী? সবাই কি বড় চাকরি করবে? আর চেহারা? তার চেহারা খুব কি খারাপ? তার চেয়ে খারাপ চেহারার ছেলেদেরকে কি মেয়েরা পছন্দ করে বিয়ে করে না?
এই মেয়েটার ছবি জহিরের দ্রুয়ারে এখনো আছে। তার শোবার ঘরের দুনম্বর ডুয়ারে। এই ড্রয়ারে তার দরকারি কাগজপত্রও থাকে। এইসব কাগজপত্র ঘাঁটতে গেলে প্রায়ই ছবিটা তার চোখে পড়ে, তখন বুকের মধ্যে হুহু করতে থাকে। ছবিটার উল্টো পিঠে ইংরেজিতে লেখা নুরুন নাহার। কে জানে, হয়ত মেয়েটা নিজেই লিখেছে। সুন্দর হাতের লেখা। বিয়ে হলে সে তাকে নাহার বলে ডাকতো।
এই নাহার, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।
এই নাহার, জানালাটা একটু বন্ধ করো না, রোদ আসছে।
নাহারের বিয়ে হয়েছে কি-না কে জানে। বিয়ে হয়ে থাকলে তার স্বামী তাকে কি নাহার নামেই ডাকে? এই একটা তুচ্ছ জিনিস কেন জানি জহিরের খুব জানতে ইচ্ছা করে। তার মনে আরেকটা গোপন ইচ্ছাও আছে। একদিন সে নাহারদের বাড়িতে উপস্থিত হবে। নাহার চমকে উঠে বলবে, আপনি কী চান? জহির বলবে, কিছু চাই না। ছবিটা ফেরত দিতে এসেছি। নাহার বিস্মিত হয়ে বলবে, কিসের ছবি?
আপনি রেলিং ধরে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ছবিটা। আপনার ফুপা আমাকে দিয়েছিলেন।
এই জন্যে কষ্ট করে এসেছেন? ছিঃ ছিঃ। আপনার কাছে থাকলেই হত। ফেরত দেয়ার কোন দরকার ছিল না। আচ্ছা, এনেছেন যখন দিন।
যাই তাহলে।
যাবেন কেন, বসুন। চা খান। আর আপনাকে আরেকটা কথা বলা হয় নি।
কী কথা?
আপনাকে বোধহয় বড় ফুপা বলেছেন যে আমি আপনাকে অপছন্দ করেছি। আসলে তা ঠিক না। আমি আপনাকে খুবই পছন্দ করেছিলাম, ওরাই রাজি হলেন না। মিথ্যা করে আমার নামে দোষ দিয়েছেন। আপনি কিছু মনে করবেন না।
আমি কিছু মনে করি নি।
এসব কথা ভাবতে জহিরের খুব ভালো লাগে। মাঝে-মাঝে চোখে পানি পর্যন্ত এসে যায়। মনে হয়, সে যা ভাবছে তাই সত্যি, আশেপাশের পৃথিবীটা সত্যি নয়।
দুপুর তিনটার দিকে জহির ঝিকাতলায় তার মামার বাসার সামনে উপস্থিত। জহিরের সঙ্গে তার মামা বদরুল সাহেবও যাবেন। তাদের যাবার কথা পাঁচটার দিকে। দুঘন্টা আগে চলে আসায় জহিরের কেমন লজা-লজ্জা লাগছে। তারা কী ভাববে, কে জানে। আরো কিছুক্ষণ পরে এলে কেমন হয়? কোন একটা চায়ের দোকানে ঘন্টাখানিক কাটিয়ে আসা যায় না? সেটাই ভালো। জহির বসবার ঘরের বারান্দা থেকে চুপিচুপি নেমে গেল।
বসবার ঘরের জানালার পাশে তরু দাঁড়িয়েছিল। তরু বদরুল সাহেবের মেজো মেয়ে। ইউনিভার্সিটিতে এইবার ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছে। বোটানিতে অনার্স। আজ তাদের একজন স্যার মারা যাওয়ায় ইউনিভার্সিটি একটার সময় ছুটি হয়ে গেছে। সে ভেবেছিল আরাম করে দুপুরে ঘুমুবে। অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে থেকেও ঘুম না আসায় সে বসার ঘরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। ভাগ্যিস দাঁড়িয়েছিল। না দাঁড়ালে এই অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেত না। জহির ভাই কেমন ঘামতে-ঘামতে এলেন। দরজার কড়া নাড়তে গিয়েও না নেড়ে কেমন চুপিচুপি নেমে গেলেন। যেন বিরাট একটা অপরাধ করেছেন। আশ্চর্য কাণ্ড, জহির ভাইকে দেখা গেল রাস্তার ওপাশে বিসমিল্লাহ হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকছেন। তরু ভেবেছিল ঢুকেই বোধহয় বের হয়ে আসবেন। সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। জহির ভাই বেরুলেন না। তরুর খুব ইচ্ছা করছে ঐ রেস্টুরেন্টে উঁকি দিয়ে দেখে ব্যাপারটা কি। ইচ্ছা করলেও যাওয়া যাবে না। ঐ রেস্টুরেন্টটা হচ্ছে বখা ছেলেদের আড্ডা। ঐসব বখাদের একজনের গানের গলা আবার খুব ভালো! স্কুল-কলেজের মেয়েরা সামনে দিয়ে গেলেই সেই বখা গায়ক গান ধরে—ও চেংড়ি চেংড়ি রে, ফিরে-ফিরে তাকায় রে। বড় সুন্দর দেখায় রো দল বেঁধে মেয়েরা যখন যায় তখন এই গান উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু একা-একা যাবার সময় গান শুনলে দুঃখে-কষ্টে চোখে পানি এসে যায়। বখাগুলো দুপুরবেলা দুটা টেবিল একত্র করে তাস খেলে। জহির ভাই ঐ বখাগুলোর সঙ্গে কী করছে? তরুর মন অস্বস্তিতে ভরে গেল।
ভাদ্রমাসের ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরগুলো
ভাদ্রমাসের ঝাঁ-ঝাঁ দুপুরগুলো এম্নিতেই ছমছমে লাগে। আজ যেন আরো বেশি লাগছে। তরু বসার ঘর থেকে ভেতরের বারান্দায় এল, সেখান থেকে শোবার ঘরে ঢুকল। তরুর মা মেঝেতে একটা বালিশ পেতে ঘুমুচ্ছেন। তার মাথার উপর সা-সা করে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসে তাঁর মাথার চুল উড়ছে। এই দৃশ্যটা তরু খানিকক্ষণ দাঁড়িয়েদাঁড়িয়ে দেখল। সেখান থেকে গেল পাশের ঘরে। এই ঘরটা তরু এবং মীর। মীরু, তরুর ছোটবোন-এবার ক্লাস নাইনে উঠেছে। সে এখনো স্কুল থেকে ফেরেনি বলেই ঘর চমৎকার গোছানো। সে ফিরে এলে মুহূর্তের মধ্যে ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। তার জন্যে মীরুকে কিছু বলা যাবে না। শেষ বয়সের মেয়ে বলে মীর মা, শাহানা, মেয়েকে কখনো কিছু বলেন না। কেউ একটা কড়া কথা বললে তিনি ব্যথিত গলায় বলেন, এইসব কী। ও ছোট না?