হ্যাঁ।
দেখলেন তো আমিও অনেক কিছু বুঝতে পারি।
তাই তো দেখছি।
আচ্ছা উনি কি বয়সে আমার বড়?
না মনে হয়।
উনি কি খুব কথা বলেন।
না। ও সবচেয়ে কম কথা বলত। এখন খুব কথা বলে। সারাক্ষণ কথা বলে।
কেন বলে জানেন?
না।
আমি জানি। উনি উনার স্বামীর কাছ থেকে বেশি কথা বলা শিখেছেন। নিশ্চয়ই উনার স্বামী খুব কথা বলেন। বিয়ের পর মেয়েরা স্বামীর মতো হয়ে যায়।
জহির হো-হো করে হেসে ফেলল।
আসমানী বলল, দেখলেন আমার কত বুদ্ধি? এখন আপনি দয়া করে একটু সরুন, আমি আমার নিজের জন্য এক কাপ চা বানাব।
মেয়েটা হাসছে। এত ভালো লাগছে দেখতে। জহির লক্ষ করল তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। তার বড়ই লজ্জা লাগছে। সে খুব চেষ্টা করতে লাগল চোখের পানি শুকিয়ে ফেলতে।
আসমানী বলল, জানেন আপনার এখানে আমি খুব ভয়ে-ভয়ে এসেছি।
কেন বল তো?
আজ বাসায় কি জানি হয়েছে। মনে হয় বিরাট কোনো ঝামেলা। আমার বিয়েটা সম্ভবত ভেঙ্গে গেছে।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, কি বলছ এসব!
সত্যি বলছি। আমি আগে-আগেই অনেক কিছু বুঝতে পারি।
বিয়েটা ভেঙ্গে গেল
আশ্চর্যের ব্যাপার, বিয়েটা ভেঙ্গে গেল।
বিয়ের ঠিক তিন দিন আগে ফর্সা লম্বা লাল টাই পরা একটা ছেলে প্রচণ্ড শব্দে আসমানীদের ঘরের কড়া নাড়তে লাগল। যেন সে অসম্ভব ব্যস্ত। যেন তার হাতে এক সেকেন্ড সময় নেই।
দরজা খুলল আসমানী।
লাল টাই পরা মানুষটি হাসিমুখে বলল, আসমান বল তো আমি কে?
আসমানী তাকিয়ে আছে। তার চোখ মাছের চোখের মতো হয়ে গেছে। সেই চোখে কোনো পলক নই। আমাকে চিনতে পারছ, না পারছ না?
পারছি।
আমি ভেতরে আসব, না আসব না?
আসুন।
দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকলে আসব কি করে?
আসমানী দরজা ছেড়ে দিল।
মানুষটি হাসতে-হাসতে বলল, আমি যে আসব তা তো সবাইকে টেলিগ্রাম করে জানিয়েছিকেউ তোমাকে কিছু বলে নি?
না।
খুবই আশ্চর্যের কথা। অবশ্যি না বলে একদিকে ভালোই করেছে। আমি নিজেই বলব। কিন্তু এখন আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না।
পারছি। পারব না কেন?
আমি জানি আমার ওপর তোমার প্রচণ্ড রাগ। আমার একটা গল্প আছে, গল্পটা শুনলে রাগ থাকবে না।
আসমানী শান্ত গলায় বলল, আমার কিছুই শুনতে ইচ্ছে করছে না।
ইচ্ছে না করলেও শুনতে হবে। এবং এখানে দাঁড়িয়ে এই গল্প আমি বলব না। আমি গাড়ি নিয়ে এসেছি, Lets go.
আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।
যেতে ইচ্ছে না করলেও তুমি যাবে। If I call you, you have to be there.
লোকটি অতি সহজ, অতি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আসমানীর হাত ধরল।
গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। আসমানীর ইচ্ছে করছে বলে, আস্তে চালান; এ্যাকসিডেন্ট হবে। আবার বলতেও ইচ্ছে করছে না।
আসমানী?
জ্বি।
গল্পটা শুরু করি—আমাদের হেলথ ইনসিওরেন্সের জন্য একটা মেডিক্যাল চেকআপ হয়। সেই চেক-আপে আমার একটা ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ ধরা পড়ল। ডাক্তাররা আমার আয়ু বেঁধে দিলেন তিন বছর। এইসব খবর তোমাকে দিলাম না। শুধু বিয়েটা ভেঙ্গে দিলাম। আসমানী?
জ্বি। তুমি মিরাক্যলে বিশ্বাস কর? মিরাকল অর্থাৎ-বাংলা শব্দটা মনে পড়ছে …. অবিশ্বাস্য ধরনের কিছু বলতে পার।
বিশ্বাস করি।
আমি করতাম না। এখন করি। কারণ পৃথিবীর যে অল্পকিছু লোক ক্যান্সার জয় করেছে আমি তাদের একজন। আজ আমার শরীরে কোনো ক্যান্সার নেই। আজ আমি একজন সুস্থ মানুষ।
বলতে-বলতে লোকটি বাঁ হাত আসমানীর কোলের ওপর রেখে আসমানীর দিকে তাকিয়ে হাসল। আসমানী বলল, আপনি দয়া করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালান। আপনি তো এ্যাকসিডেন্ট করবেন।
আসমানী?
জ্বি।
আমি জহির সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি তাঁর কাছে নতজানু হয়ে তোমাকে প্রার্থনা করেছি। মানুষটির হৃদয় দেখে আমি মুগ্ধ। তিনি কী বলেছেন শুনতে চাও?
ধরা গলায় আসমানী বলল, না, উনি কি বলবেন আমি জানি।
মনটাকে শক্ত করুন
রাত প্ৰায় দশটা।
জহির রান্না বসিয়েছে।
তেলটা খারাপ। প্রচুর ধোঁয়া হচ্ছে। জহিরকে বার-বার চোখ মুছতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে বুঝি খুব কাঁদছে। আসলেই তাই। ধোঁয়া ছাড়াই জহিরের চোখ বারবার ভিজে উঠছে।
অরুর শরীরটা খুব খারাপ। আজ তৃতীয় দিন। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছিল। ক্রমাগত ব্লিডিং হচ্ছে। ছব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। আরও দিতে হবে। আজ সন্ধ্যায়, ডাক্তাররা বলেছেন অবস্থা ভালো না।
জহির সারাদিন পাশে বসে ছিল। একসময় অরু বলল, এত মন খারাপ করে আমার পাশে বসে থাকবেন না। আমার পাশে বসতে হলে হাসিমুখে বসতে হবে।
জহির বলল, আমি তোমার মতো কথায়-কথায় হাসতে পারি না।
ইচ্ছা করেন না তাই পারেন না। ইচ্ছা করলেই পারবেন।
জহির বলল, সত্যি করে বল তো তোমার কি খারাপ লাগছে না?
অরু ক্লান্ত গলায় বলল, নিজের জন্য লাগছে না, বাচ্চাটার জন্য লাগছে। এত সুন্দর পৃথিবীর কিছুই সে দেখবে না? না দেখেই মরে যাবে?
চুপ করে শুয়ে থাক অরু। বেশি কথা বলা বারণ।
জহির ভাই, আসমানী কি তার স্বামীর সঙ্গে চলে যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?
হ্যাঁ।
কিছু বলেছিল?
না। অরু বলল, আপনি খুব ভাগ্যবান মানুষ জহির ভাই।
কেন বল তো?
এই মেয়েটি জনম জনম আপনার জন্য কাঁদবে। এত বড় সৌভাগ্য কজন পুরুষের হয় বলুন?
বড্ড ধোঁয়া হচ্ছে। জহির রান্নাঘর থেকে বারান্দায় চলে এল। অবাক হয়ে দেখল বারান্দার রেলিং ধরে আজহার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন। আকাশের দিকে।