জহির ঘরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল, কখন এসেছ অরু?
অরুবলল, অনেকক্ষণ। আপনার চাবি খুজে পাই নি বলে তালা ভেঙেছি। সরি ফর দ্যাট। তবে আপনার অনেক কাজ করে রেখেছি। রান্না করেছি। আসুন দুজনে খেতে বসে যাই। নাকি গোসল করবেন? যদি গোসল করতে চান গরম পানি করে দিতে পারি। বলতে-বলতে অরু মিষ্টি করে হাসল।
জহির কিছুই বলতে পারছে না। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরু বলল, আপনি এতে অবাক হচ্ছেন কেন? আপনি নিশ্চয়ই জানতেন, আমি একদিন আসব। জানতেন না?
জানতাম।
অরুকে কেমন রোগা-রোগা লাগছে। তার চোখের নিচে কালি। গাল ঈষৎ লালচে। সম্ভবত গায়ে হাত দিলে উত্তাপ টের পাওয়া যাবে।
জহির ভাই?
বল।
আপনার মনে যদি কোনো কঠিন প্রশ্ন থাকে তার উত্তর খেতে খেতে দেয়া যাবে। আরেকটা কথা, আপনাকে এমন লাগছে কেন? ভয়ঙ্কর কিছু কি ঘটেছে?
না।
তাহলে মুখ এমন গোমড়া করে রাখবেন না। আজহারের প্রেমে পড়েছিলাম কেন জানেন? ঐ লোকটা মুখ গোমড়া করতে পারত না। ভয়ঙ্কর কঠিন সময়েও হেসে ফেলত। আর এমন সুন্দর করে হাসতো যে তার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিতাম। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করত—ফিরি ফিরি নিতি তব চরণে আসিব।
জহির অবাক হয়ে লক্ষ করল, অরুর চোখে পানি এসে গেছে, সে চোখ মুছছে।
অরু বলল, এতো অল্প সময়ে বেশি কিছু রাঁধতে পারি না। একটা পচা বেগুন ছিল ভর্তা করে ফেলেছি। পচা বেগুনের ভর্তা খুবই ভালো জিনিস। ডাল রান্না হয়েছে। আমার ধারণা ডালের মধ্যে তেলাপোকা ডিম পেড়েছিল। কেমন তেলাপোকা-তেলাপোকা গন্ধ। আপনার স্ত্রী আসমানী এসে সব ঠিক করবে।
জহির বলল, এতোদিন কোথায় ছিলে?
মাই গড, একেবারে জীবনানন্দ দাশ-এতোদিন কোথায় ছিলেন? হাসপাতালে ছিলাম। এম, আর, করিয়েছি। এম. আর. কি জানেন?
না।
পেটে যদি আনওয়ান্টেড কোনো শিশু চলে আসে, তাহলে বর্তমান আধুনিক ডাক্তারী শাস্ত্ৰ মাকে কোনো রকম কষ্ট না দিয়ে শিশুটিকে মেরে ফেলতে পারে। শিশুটি হয়ত কষ্ট পায়, কিন্তু সে তার কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারে না বলে আমরা তা জানি না। জহির ভাই, আপনি এমন ঘৃণা-ঘৃণা চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? আপনার কি মনে হচ্ছে আমি একজন খুনী?
না।
আমি জানি হচ্ছে। আপনার চোখ দেখে বুঝতে পারছি। আপনার কোনো দোষ নেই। আমারও নিজেকে খুনী মনে হয়। সারাক্ষণ মনে হয় ঐ শিশুটা দূরে থেকে আমাকে দেখছে। আমার কি ধারণা জানেন? আমার ধারণা ঐ শিশুটা একটা মেয়ে। আমি ওর নাম দিয়েছি রাত্রি, যদিও তার এখন আর নামের কোন দরকার নেই। রাত্রি নামটা কি সুন্দর না জহির ভাই?
হ্যাঁ সুন্দর। খুব সুন্দর।
আপনার যদি কোনোদিন মেয়ে হয়, আপনি এর নাম রাখবেন রাত্রি।
আচ্ছা রাখব।
প্রমিজ করুন।
করছি।
না, এভাবে করলে হবে না, আমার হাত ধরে করুন।
জহির অরুর হাত ধরল, নরম গলায় বলল, যে কাজটা করে তুমি এত কষ্ট পেলে সে কাজটা কেন করলে?
রাগ করে করলাম জহির ভাই। প্ৰচণ্ড রাগ হল। সবার ওপর রাগ। ঐ বুদ্ধিমান অথচ হৃদয়হীন মানুষটির ওপর রাগ। কেন জানি আপনার ওপরও রাগ হয়েছিল।
আমি তো তোমার রাগের যোগ্য নই, অরু। আমি অতি নগণ্য একজন, অতি তুচ্ছ।
হ্যাঁ, তুচ্ছ, তুচ্ছ তো বটেই।
অরু ভাতের থালা সরিয়ে উঠে পড়ল।
জহির বলল, কি হয়েছে?
অরু বলল, বুঝতে পারছি না, সম্ভবত বমি আসছে।
সে ছুটে গেল বাথরুমে। চোখে-মুখে পানি দিয়ে ফিরে এল। হালকা গলায় বলল, জহির ভাই আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন।
কোন বাসায়?
আমার স্বামীর বাসায়, আবার কোথায়! অবশ্য আপনি যদি এখানে থেকে যেতে বলেন, তাহলে ভিন্ন কথা। বলবেন? সাহস আছে?
রিকশায় যেতে-যেতে অরুবলল, আমার বায়োলজি খাতাটা আপনার বাসায় দেখলাম। খাতায় লেখা কথাগুলি কি আপনি বিশ্বাস করেছেন?
হ্যাঁ।
আপনি আসলেই বোকা। সব মিথ্যা। আজহারকে কষ্ট দেয়ার জন্যে লিখেছিলাম।
জহির নিচু গলায় বলল, সব মিথ্যা?
হ্যাঁ, সব। বাচ্চা নষ্ট করার যে গল্পটি করলাম, তাও মিথ্যা। জহির ভাই, আমি চমৎকার একজন অভিনেত্রী। এতো চমৎকার যে, আমার কোনটা অভিনয় আর কোনটা অভিনয় নয়—তা আমি নিজেও জানি না।
তোমার বাচ্চা তাহলে নষ্ট হয় নি?
না। জহির ভাই আপনি দয়া করে আরেকটু সরে আসুন। আমি অচ্ছুৎ কেউ না। আমার গায়ে গা লাগলে পাপ যদি হয় আমার হবে, আপনার হবে না।
জহির বলল, তোমাকে দেখে আজহার সাহেব খুব খুশি হবেন।
হা হবেন। আচ্ছা জহির ভাই, একটা মজার কথা বলি?
বল।
মাঝে-মাঝে আপনার বোকামিতে আমার গা জ্বলে যায়, আবার আপনার এই বোকামিটাকেই আমি ভালবাসি। সেই সঙ্গে আপনাকেও।
অরু চুপ কর তো।
অরু হাসতে-হাসতে বলল, আরে বাবা, অভিনয় করছি। আপনি কি ভাবছেন এগুলো সত্যি কথা? কোনো সুস্থ মাথার মেয়ে কি রিকশায় বসে প্রেমের সংলাপ বলতে পারে? আপনি নিজেকে যতটা বোকা ভাবেন আসলে আপনি তার চেয়েও বোকা।
জহির চুপ করে রইল।
অরু গুনগুন করছে…..জনম জনম কাঁদিব…..। এটা বোধহয় তার খুব প্রিয় গান।
একটা সূক্ষ্ম কোন পরিবর্তন ঘটে গেছে
একটা সূক্ষ্ম কোন পরিবর্তন ঘটে গেছে।
কেউ কিছু বলছে না কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। সব বলতে হয় না। না বললেও অনেক কিছু বোঝা যায়। তা ছাড়া আসমানী বোকা মেয়ে নয়। সে বুঝতে পারছে কিছু একটা হয়েছে এবং তাকে নিয়েই হয়েছে। সেই কিছুটা কি? তাকে কেউ বলছে না। কখনো বলে না। সে কি নিজেই কাউকে জিজ্ঞেস করবে? এতটা নির্লজ্জ কি সে হবে?