এখন কি তুমি সেজো সাহেবের কাছে গিয়েছিলে?
জ্বি।
সেজো সাহেব তোমাকে কিছু বলেছেন?
জ্বি না।
করিম সাহেব জহিরকে নিয়ে কোনো চায়ের দোকানে ঢুকলেন না। অফিস থেকে রাস্তায় বের হয়ে শুকনো গলায় বললেন, তোমার যে চাকরি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে তুমি কিছু শুনেছ?
জহির তাকিয়ে আছে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। চাকরি নিয়ে সমস্যা হবে কেন? সমস্যা হবার কি আছে?
করিম সাহেব বললেন, আমি ব্যাপারটা জানলাম কাল বিকাল তিনটায়। বড় সাহেব ছিলেন না। সেজোর সঙ্গে দেখা করলাম, তিনি বললেন–চাকরির কন্ডিশনই ছিল—টেম্পোরারি এ্যাপয়েন্টমেন্ট। ছাঁটাই হলে অসুবিধা নেই।
জহির হতভম্ব হয়ে বলল, গত বছর তো স্যার পার্মানেন্ট হয়েছে।
আমিও সেই কথাই বললাম। তিনি ফাইল বের করে দেখালেন যে চাকরি এখনো টেম্পোরারি।
ছাঁটাই কি হয়ে গেছে স্যার?
না এখনো হয় নি।
জহির তাকিয়ে আছে।
করিম সাহেব ছোট-ছোট নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। তাঁর চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব কষ্ট পাচ্ছেন।
জহির?
জ্বি স্যার।
আমি কাল রাতে তোমার বাসায় গিয়েছিলাম, অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি। তুমি ছিলে না।
বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল।
জহির?
জ্বি স্যার।
তোমাকে আমি কী রকম পছন্দ করি তা কি তুমি জান?
জানি স্যার।
না জান না কারণ আমি নিজেও জানতাম না। কাল সারারাত আমি ঘুমাই নি, বারান্দায় বসে ছিলাম।
বলতে-বলতে করিম সাহেবের গলা ধরে এল। আসলেই এই ছেলেটির প্রতি তার মমতার পরিমাণ তিনি এর আগে কখনো বুঝতে পারেন নি। যে ছেলের দুদিন পর বিয়ে আজ তার চাকরির সমস্যা। এই ব্যাপারটা তাঁকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে। কেন এমন হবে?
জহির?
জ্বি স্যার।
তোমার বিয়ের ব্যাপারটা ঠিক আছে তো?
জ্বি স্যার, এখনো আছে।
ঠিক রাখবে। মেয়ে পক্ষীয়দের কিছুই জানানোর দরকার নেই। তুমি ভয় পেও না। মানুষের ভাগ্য মানুষের কাছে না, আল্লাহর কাছে। একটা কিছু হবেই।
জহির চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
করিম সাহেব বললেন, হঠাৎ করে তোমার চাকরি নিয়ে সমস্যাটা কেন হল তা। বুঝতে পারছিনা। ইউনিয়নের লিডার মকবুলকে বললাম, মকবুল বলল দেখবে। কিন্তু তার কথার মধ্যে কোনো জোর নেই। দেখলে তো এখনই দেখতে হবে। চাকরি চলে গেলে দেখার কি থাকবে? মকবুলটা একটা হারামজাদা।
অর্ডার কি স্যার হয়ে গেছে?
না, তবে হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সেজো সাহেবের কোনো রিলেটিভ ঢুকবে। একটা ছেলের নামে এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারও ইস্যু হয়েছে।
আমি এখন কী করি স্যার?
করিম সাহেব কিছু বললেন না। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর বড় কষ্ট হচ্ছে।
স্যার, আমি কি বাসায় চলে যাব, না অফিসে কাজ করব?
বাসায় যাবে কেন? বাসায় যাবার কি আছে? অফিসেই থাক। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।
আশ্চর্যের ব্যাপার। এতো ভয়াবহ একটা খবর, অথচ জহির কাউকেই তা দিতে পারল না।
বরকত সাহেবের বাসায় গেল। শাহানা তার সঙ্গে একটি কথা বললেন না। তরু এবং মীরু দুজনের কেউই বাসায় নেই। ওরা কোথায় জিজ্ঞেস করায় শাহানা তীক্ষ্ণ গলায় বলল, আমি কি রেলের টাইম-টেবিল? কে কোথায় গেছে হিসাব রাখব? বরকত সাহেবও কোনো কথা বললেন না। শুধু দুবার বললেন তাঁর শরীরটা ভালো না, মাথাব্যথা। এটা আসলে প্রকারান্তরে বলে দেয়া তুমি এখন যাও।
জহির বলল, অরুর কি কোনো খবর পাওয়া গেছে মামা?
না। খবর নিয়ে ভাবছিও না। No News is good News. আচ্ছা জহির, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল তোমার বিয়ে উপলক্ষে ভালো কিছু দেয়া—এক জোড়া কানের দুল কেনা হয়েছে। তুমি মেয়েকে যে গয়না পাঠাবে তার সাথে দিয়ে দিও। দুল জোড়া তরুকাছে আছে। ঐ নিয়ে আরেকদিন আলাপ করব। আজ যাও। শরীরটা ভালো না, মাথা ধরেছে।
জহির উঠে পড়ল। তার ভাগ্যটা অদ্ভুত। খুব কষ্টের সময় সে আশেপাশে কাউকে পায় না, যাকে কষ্টের কথা বলা যায়। সে এখন যদি আসমানীর কাছে চলে যায় তাহলে কেমন হয়? সে কি আসমানীকে বলতে পারে না আসমানী, আজ আমার খুব কষ্টের দিন। আজ আমার চাকরি চলে গেছে।
না কি সে সেজো সাহেবের বাড়িতে যাবে? সেজো সাহেবের স্ত্রীকে বলবে,ম্যাডাম সাত দিন পর আমার বিয়ে অথচ…..।
কোনো পীর সাহেবের কাছে গিয়ে দোয়া চাওয়া যায় না? তাঁদের কত রকম ক্ষমতার কথা শোনা যায় সত্যি-সত্যি হয়ত তাঁদের ক্ষমতা আছে। সবাই সেইসব ক্ষমতার খবর রাখে না।
জহির কোথাও গেল না। কলাবাগানের বাচ্চাদের পার্কের একটা বেঞ্চিতে অনেক রাত পর্যন্ত বসে রইল। ঘরে ফিরতে ইচ্ছা করছে না। আজ অসম্ভব গরম পড়েছে। তার বুক কাঁপছে। সে খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না। এ রকম হচ্ছে কেন? কেন এ রকম হচ্ছে? বার বার সুশীতল একটা নদীর ছবি শুধু মনে আসছে। যেনদীতে গা ডুবিয়ে শুয়ে থাকা যায়। সেই নদীর জলের টান খুব প্রবল, প্রবল টানে শুধু দক্ষিণের দিকে ভেসে ভেসে যাওয়া। দক্ষিণের সমুদ্র। তারও দক্ষিণে কি?
আকাশ মেঘলা।
ফোঁটায়-ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে।
জহির এক সময় উঠল।
জহিরের ঘরের দরজা খোলা।
বাতি জ্বলছে। জহির বারান্দায় থমকে দাঁড়াল। ভেতর থেকে গুনগুন করে গান। শোনা যাচ্ছে–
জনম জনম তব তরে কাঁদিব।
যতই ভাঙিবে খেলা
ততই সাধিব।
তোমারই নাম গাহি
তোমারই প্রেম চাহি
ফিরে ফিরে নিতি তব চরণে আসিব।
খুব কষ্টের একটা গান। কিন্তু গাওয়া হচ্ছে হাসি-তামাসা করে, যেন এটা মূল গানের একটা প্যারোডি, যেন কোনো একটা হাসির গান।