আমার গাড়ি লাগবে না স্যার। আপনার কিছু বলার দরকার নেই।
তুমি থাক কোথায়?
কল্যাণপুর।
বাবা-মা সঙ্গে আছেন, না একাই থাক?
বাবা-মা বেঁচে নেই স্যার।
ও আচ্ছা-আচ্ছা।
করিম সাহেব খানিকটা বিব্রত বোধ করলেন। এই ছেলে তিন বছর ধরে তার সামনের টেবিলে মাথা গুজে কাজ করছে অথচ তিনি তার সম্বন্ধে কিছুই জানেন না, ব্যাপারটা অন্যায়ই হয়েছে। খুবই অন্যায়।
বাসা ভাড়া করে থাক?
জি স্যার।
ভাড়া কত?
নয় শ টাকা।
বল কি, নয় শ টাকায় বাড়ি হয়?
ছোট বাসা। দুইটা রুম। অনেক ভেতরের দিকে। গ্যাস নাই তাই…..
করিম সাহেব খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, টাকা যা পাও তাতে চলে? চলার তো কথা না।
দুইটা টিউশানি করি।
অফিসের কাজের পরে টিউশানির ধৈর্যও থাকে?
উপায় কি স্যার?
তা ঠিক। উপায় নেই, বাঁচাই মুশকিল। তবু যে মানুষ বেঁচে আছে এইটাই আশ্চর্য।
আমি স্যার যাই।
দাঁড়াও একটু। জি. এম. সাহেবের সঙ্গে কথা বলে নিই।
কোন দরকার ছিল না স্যার।
একটু অপেক্ষা করলে ক্ষতি তো কিছু নেই। তুমি তোমার টেবিলে গিয়ে বস খানিকক্ষণ। কিংবা যাও কেন্টিনে বসে এককাপ চা খাও।
জহির অস্বস্তি নিয়ে কেন্টিনে চলে গেল। অস্বস্তির কারণ হচ্ছে, করিম সাহেব খুবই গচটা ধরনের মানুষ। হঠাৎ-হঠাৎ অসম্ভব রেগে যান। আজ তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, মোজাফফর সাহেবের সাথে একটা ছোটখাট চটচটি হয়েছে। জ্বি এম সাহেবের সঙ্গেও হয় কি না কে জানে। হওয়া বিচিত্র না।
অফিস কেন্টিনে চা ভালো বানায়, কিন্তু আজকেই চা-টা মুখে দেয়া যাচ্ছে না। কেমন একটা বিস্বাদ, তিতকুটে ভাব। জহির সিগারেট ধরাল। সে দরজার দিকে মুখ করে বসেছে, যাতে করিম সাহেবকে আসতে দেখলে চট করে ফেলে দিতে পারে। সিগারেটও ভালো লাগছে না, বরং মাথা ঘুরছে। মেয়ে দেখতে যাবার উত্তেজনায় এরকম লাগছে কি না কে জানে। এই মেয়েটির আগে সে আরো দুজনকে দেখেছে, তখন এরকম অস্বস্তি লাগে নি। আজকের বাড়াবাড়ি উত্তেজনার কারণ হচ্ছে জহিরের মামা বলেছেন, একটা আংটি সাথে করে নিয়ে যাও। পছন্দ হলে বিসমিল্লাহ বলে আংটি পরিয়ে দিলেই হবে। এনগেজমেন্টের যন্ত্রণা মিটে গেল। তবে মেয়ে তোমার পছন্দ হবে। রূপবতী মেয়ে, একটু অবশ্যি রোগা। তাতে কি? আজকালকার মেয়ে সবাই লোগা।
আংটি জহির গতকাল কিনেছে। পাথর বসানো আংটি। এতটুকু একটা জিনিস দাম নিল সাত শ টাকা। রোগা মেয়েদের আঙুলও সরু সরু হয় কি না কে জানে। অবশ্যি না লাগলে অসুবিধা হবে না, দোকানে বলা আছে ওরা বদলে দেবে। জহির পকেট থেকে আংটির বাক্সটি বের করে আবার সঙ্গে সঙ্গে পকেটে ভরে ফেলল। করিম সাহেব হঠাৎ চলে এলে লজ্জায় পড়তে হবে। আচ্ছা আংটিটা আগ বাড়িয়ে কেনা ঠিক হয়েছে কি? যদি মেয়ে পছন্দ না হয়? পছন্দ না-ও তো হতে পারে।
অবশ্যি জহিরের মন বলছে, মেয়ে পছন্দ হবে। এর আগে যে দুজনকে সে দেখেছে তাদেরকে সে পছন্দ করেছে। প্রথম যে মেয়েটাকে দেখল তার নাম আসমা। কী শান্ত নিগ্ধ চেহারা। চায়ের ট্রে নিয়ে খালি পায়ে ঘরে ঢুকেছিল। ঘরে ঢুকবার সময় চৌকাঠে হোঁচট খেল। একটা চায়ের কাপ উলটে গেল। মেয়ের এক চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, কী যন্ত্রণা চাচার কথা শুনে মেয়েটার মুখ লজ্জায় ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জহিরের মনটা মায়ায় ভরে গেল। সে মনে-মনে বলল, আহা বেচারি।
এত পছন্দ হয়েছিল মেয়েটিকে অথচ বিয়ে হল না। কথা বাৰ্তা ঠিকঠাক হবার পর হঠাৎ শুনল মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে সিলেটের চা বাগানের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। ভালো একটা ছেলে পেয়ে মেয়ের বাবা-মা রাতারাতি বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। মাসখানিক জহির খুব কষ্টে কাটিয়েছে। শুধু মেয়েটার কথা মনে পড়ত। তিনবার তাকে স্বপ্নেও দেখল। একটা স্বল্প খুব অদ্ভুত। যেন তাদের বিয়ে হয়েছে। জহির বিয়ের পরদিনই একটা চা বাগানে ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে চলে গেছে। কী আশ্চর্য, একা-একা আসমা সেই চা বাগানে এসে উপস্থিত। জহিরকে দেখে কান্না-কান্না গলায় বলল, তুমি পারলে আমাকে ফেলে চলে আসতে? তুমি এত পাষাণ? জহির হাসতে-হাসতে বলল, কি মুশকিল, আমার কাজ-কর্ম আছে না? চা বাগানের ম্যানেজারির যে কী যন্ত্রণা তা তো তুমি জান না। আসমা এই কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে রইল তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, তুমি যদি এই মুহূর্তে সব ছেড়ে আমার সঙ্গে না আস তাহলে আমি বিষ খাব। এই দেখ, আমার শাড়ির আঁচলে বিষ বাঁধা আছে। স্বপ্নে ব্যাপারগুলো খুব দ্রুত ঘটে। এই স্বপ্নেও তাই হল। আসমা হঠাৎ শাড়ির আঁচল খুলে সবটা বিষ মুখে দিয়ে দিল।
জহির।
জহির চমকে উঠে দাঁড়াল। করিম সাহেব কখন ঘরে এসে ঢুকেছেন সে বুঝতেই পারে নি।
তুমি চলে যাও জহির। গাড়ি পাওয়া যায় নি। কিছু মনে করে না, তোমাকে অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলাম।
জ্বি না স্যার। মনে করার কি আছে।
মনে করার অনেক কিছুই আছে। এখন এটা নিয়ে কথা বলতে চাই না। আচ্ছা। তুমি যাও।
করিম সাহেবের মুখ থমথম করছে। জহিরের অস্বস্তির সীমা রইল না। স্যার নিশ্চয়ই জি, এম, সাহেবের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করেছেন। ব্যাপারটা ভালো হল না। জহিরের মনে কঠিন একটা কাঁটা বিধে রইল। জি. এম. সাহেব লোক সুবিধার না। করিম সাহেবের সঙ্গে যদি কথা কাটাকাটি হয় তাহলে ব্যাপারটা তিনি সহজে ভুলবেন না। এবং সুযোগ বুঝে শোধ তুলবেন।
আসলে আজকের দিনটিই জহিরের জন্যে খারাপভাবে শুরু হয়েছে। গতরাতে একটা পাউরুটি এনে রেখেছিল, সকালে উঠে চায়ের সঙ্গে খেয়ে নেবে। সকালবেলা দেখা গেল পাউরুটি বাসি। মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিতে হল। মুখে দেয়া যায় না এমন টক।