অবশ্যই পারল। আমি যেমন মেয়ে তরুও তো তেমনি মেয়ে। ও কেন পারবে না? ওকে চড়টা দিয়েই আমি দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগলাম। তরু আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করতে লাগল। আহা রে, এত ভালো কেন আমার বোনটা।
** জহির ভাইকে আমার এত ভালো লাগে কেন তা বুঝতে চেষ্টা করছি। কারণ নেই। কোনো কারণ নেই। এই মানুষটা একটা অকাট গাধা, একটা ছাগল। একবারের কথা, বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ঢাকায় ফিরছি। আমি বললাম, জহির ভাই আসুন আমরা ডেকের বেঞ্চিতে বসে চাঁদের আলো দেখতে-দেখতে যাই। গাধাটা বলল, ঠাণ্ডা লাগবে না। আমি বললাম, লাওক। আমি একা-একা বসে আছি, গাধাটা কোত্থেকে একটা কম্বল না কী-যেন এনে আমার গায়ে জড়িয়ে দিল। যখন কম্বলটা জড়িয়ে দিচ্ছে তখন হঠাৎ কেন জানি আমার চোখে পানি এসে গেল। এর নামই কি ভালবাসা? এই ভালবাসা কোথায় লুকিয়ে থাকে? কোন অচেনা জগতে? কোন অচেনা ভূবনে? কি করে সে আসে? কেন সে আসে? কেন সে আমাদের অভিভূত করে?
জহির ভাই আমার পাশে বসলেন। জড়সড় হয়ে বসলেন। একটু সরে বসলেন, যেন গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। আমি বললাম, এমন দূরে সরে বসেছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমার গার সঙ্গে গা লাগলে আপনার পাপ হবে?
জহির ভাই বিড়বিড় করে কী যেন বললেন।
আমি বললাম, আসুন তত আপনি আমার আরো কাছে সরে আসুন।
তিনি কাছে এলেন, আমি মনে-মনে বললাম, জনম জনম তব তরে কাঁদিব।
কি আশ্চর্য! কেন কাঁদব? কী আছে এই মানুষটির? হে ঈশর, ভালবাসা কী আমাকে বুঝিয়ে দাও।
** রাত কত হবে?
দুটা? তিনটা? না তার চেয়েও বেশি। আমি দরজা খুলে বের হলাম। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে। কী জোছনা। জোছনায় মন এমন করে কেন? অনেকক্ষণ বসে রইলাম বারান্দায় আমার মাথাটা হঠাৎ গণ্ডগোল হয়ে গেল। আমি বসার ঘরে ঢুকলাম। ওখানে একটা খাটে জহির ভাই কদিন ধরে আছেন। আমি ঘরে ঢুকলাম খুব সাবধানে। আমি একটা ঘরের মধ্যে আছি। কি করছি বুঝতে পারছি না। জহির ভাইয়ের টের পাশে বসলাম। আমার ধারণা ছিল তিনি ঘুমাচ্ছেন। আসলে তিনি ঘুমুচ্ছিলেন না। আমি পাশে বসা মাত্র জহির ভাই বললেন, অরু—তুমি ঘুমাতে যাও। আমি একটা কথা না বলে উঠে চলে এলাম। এর পরে কতবার দেখা হল, আমরা দুজনে এমন ভাব করলাম যেন এমন একটি ঘটনা কোনো দিন ঘটে নি। কিংবা কে জানে, হয়ত সত্যি এমন কোনো ঘটনা ঘটে নি। হয়ত এটা একটা স্বপ্নদৃশ্য।
করিম সাহেব জহিরকে ডেকে পাঠিয়েছেন
করিম সাহেব জহিরকে ডেকে পাঠিয়েছেন। বেয়ারা দিয়ে স্লিপ পাঠিয়েছেন, তুমি দেখা কর। জরুরি।
জহির স্লিপ পেয়েই সঙ্গে-সঙ্গে আসতে পারল না। তাঁকে যেতে হল সেজো সাহেবের কাছে। এই অফিসের তিন সাহেব বড়, মেঝো এবং সেজো। সবচে মেজাজী সাহেব হচ্ছেন সেজো জন। অদ্ভুত কোনো কারণে তাঁর ক্ষমতাও মনে হয় খুব বেশি। যদিও মানুষটা মিষ্টভাষী। কখনো রাগেন না। অফিসের যে কোনো কর্মচারী তাঁর ঘরে ঢকামাত্র হাসিমুখে বলেন, আগে বলুন তো দেখি কেমন আছেন?
কর্মচারী হাত কচলে বলে, জ্বি স্যার আপনার দেয়া।
আপনাকে আজ এমন রোগা-রোগা লাগছে কেন? বাড়িতে অসুখ-বিসুখ?
কর্মচারী আরো বিগলিত হয়ে বলে, জ্বি না স্যার। জ্বি না। সব ঠিক আছে স্যার।
সব যদি ঠিক থাকে তাহলে আমার সামনে হাসিমুখে বসুন। দুএকটা হাসিতামশার কথা বলুন। চা চলবে?
সকলেই জানে এইসব আলগা খাতিরের কথার আসলে কোনো মানে নেই। পুরাটাই এক ধরনের ভড়ং, এক ধরনের ভান। তবুও কেন জানি ভড়ংটাই ভালো লাগে। ভানটাকেই সত্যি ভাবতে ইচ্ছা করে।
জহির ভয়ে-ভয়ে বলল, স্যার আসব?
আসুন, জহির সাহেব, বসুন, খবরাখবর কি বলুন। আপনাকে রোগা-বোগা লাগছে কেন? কানের কাছে কয়েক গাছি পাকা চুল দেখতে পাচ্ছি। ব্যাপারটা কি বলুন তো? আপনাদের মতো ইয়াংম্যানরা যদি চুল পাকিয়ে ফেলেন তাহলে সংসার চলবে কীভাবে? চা চলবে?
জহির এই দীর্ঘ প্রস্তাবনার কিছুই বুঝতে পারল না।
সেজো সাহেব বিনা কারণে গল্প করে সময় নষ্ট করার মানুষ নন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্যটাও জহির ধরতে পারছে না। কাজকর্ম কেমন চলছে সেটা জিজ্ঞেস করলেন, এই চাকরি কীভাবে পাওয়া গেল তা জানতে চাইলেন। আমাদের দেশের অবস্থা দশ। বছর পর কী হবে তাও বললেন। জহির হা-হু ছাড়া কিছুই বলল না। সে কি বলবে? চা শেষ হবার পর সেজো সাহেব বললেন, আচ্ছা যান।
জহির ক্ষীণ স্বরে বলল, কী জন্যে ডেকেছিলেন স্যার?
এম্নি ডাকলাম। গল্প করার জন্যে ডাকা। আমরা এক অফিসে কাজ করিকেউ। বড় কাজ করি, কেউ ছোট। তাতে তো কিছু যায় আসে না। সম্পর্ক তো রাখতেই হবে। আমেরিকায় আমি দেখেছি অফিসের বস এক টেবিলে বসে জেনিটারের সঙ্গে চা খাচ্ছে। Can you imagine? একজন জেনিটার। যার কাজ হচ্ছে বাথরুম পরিষ্কার করা। আচ্ছা জহির সাহেব যান। পরে দেখা হবে।
জহির পুরোপুরি হতচকিত অবস্থায় বের হয়ে এল। তৎক্ষণাৎ করিম সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেল। করিম সাহেব কি একটা ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছিলেন। তিনি ফাইল বন্ধ করে বললেন, চল আমার সঙ্গে। প্রথম গেলেন ক্যান্টিনে। ঢুকতে গিয়েও ঢুকলেন না। বললেন, এখানে ভিড় বড় বেশি, চল বাইরে কোথাও যাই।
ব্যাপার কি স্যার?
করিম সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, ব্যাপার কি তুমি কিছুই জান না?
জ্বি না।
গতকাল অফিসে আস নাই?
জ্বি না। আমার এক মামাতো বোন, স্যার তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। অরু তার নাম। আপনি বোধ হয় দেখেছেন, কয়েকবার অফিসে এসেছে।