আমার সঙ্গে দেখা করবে কেন?
কারণ আপনাকে সে ভালবাসে। আপনি একটা মহা গাধা বলে এই সহজ জিনিসটা ধরতে পারেন নি। শুধু যে সেই আপনাকে ভালবাসে তাই না, অরুর ছোট বোন তরু…..ঐ মেয়েটিও আপনার জন্যে পাগল। এই তথ্যটাও আপনার জানা নেই। আপনি তো ভাই বিশ্বপ্রেমিক।
জহির চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। আজহার সাহেব বললেন, বোকামি ছাড়া আপনার মধ্যে এমন কিছু নেই যা চোখে পড়ে। এই বোকামির জন্যেও যে মেয়েরা প্রেমে পড়তে পারে তা আমার জানা ছিল না। আপনি এখন যদি চলে চান, চলে যেতে পারেন। বোকা মানুষদের আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারি না।
A rich man you can tolerate many times
A wise man can only twice be tolerated
But a fool..
বাকিটা শেষ করলাম না। শেষ করলে মনে কষ্ট পাবেন। আসুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
এগিয়ে দিতে হবে না।
হবে রে ভাই হবে। এগিয়ে দিতে হবে। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। ছাতা নিয়ে এইজন্যেই যাচ্ছি। সেতুলে দিয়ে আসব। এতটুকু গুণ আমার আছে। তা ছাড়া জানেন না বোধ হয় যে মাতালদের ভদ্রতাবোধ হয় অসাধারণ।
আপনি মাতাল হন নি।
হয়েছি। মাতাল হয়েছি। ভালোমতোই হয়েছি। মদ না খেয়েও মানুষ মাতাল হতে পারে। একটা ভালো কবিতা পড়ে মাতাল হতে পারে, একটা সুন্দর সুর শুনে মাতাল হতে পারে, প্রেমে পড়েও মাতাল হতে পারে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে আজহার সাহেব বললেন, মাতালদের ফেভারে কিছু চমৎকার কথা আছে আপনাকে বলছি শুনুন। অরুকে বলায় অরু খুব মজা পেয়েছিল আপনিও পাবেন। আপনি তো অরুর বন্ধু-বলব?
বলুন।
একজন মাতাল অতি সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে।
একজন ঘুমন্ত মানুষ কোনো পাপ করতে পারে না।
যে পাপ করতে পারে না সে স্বর্গে যায়।
কাজেই মাতালরা সব সময় স্বর্গে যায়।
মজার কবিতা না?
জহির জবাব দিল না। রাস্তায় প্রচণ্ড বৃষ্টি। আজহার সাহেব নিজে ভিজতে-ভিজতে অনেক ঝামেলা করে জহিরকে একটা রিকশা করে দিলেন। রিকশায় উঠবার ঠিক আগমুহূর্তে বললেন, আপনাকে অনেক মন্দ কথা বলেছি, দয়া করে মনে কিছু করবেন না। আপনার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছি—অরুর ব্যক্তিগত একটা খাতা–ডায়েরিও বলতে পারেন। আমার সম্পর্কে এই খাতায় সে অনেক কিছু লিখেছে। পাশাপাশি আপনার কথাও লিখেছে। পড়লে আপনার ভালো লাগবে।
তাই নাকি?
জ্বি। অরু ফিরে না এলে আমি পাগল হয়ে যাব জহির সাহেব।
আজহার সাহেব রিকশাওয়ালা এবং আশেপাশের দুএকজন মানুষকে সচকিত করে হঠাৎ হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন। মাতালের কান্না নয়, জগৎ সংসার ছারখার হয়ে যাওয়া একজন মানুষের কান্না। রিকশাওয়ালা পর্যন্ত অভিভূত হয়ে বলল, ভাইজান কাইন্দেন না-আল্লারে ডাকেন। আল্লা ছাড়া আমরার আর কে আছে।
সুন্দর ডায়েরিতে মেয়েরা খুব যত্ন করে অনেক কিছু লেখে। এই লেখা মোটেই এরকম নয়। মোটা লাইন টানা একটা খাতা। শুরুতে বায়োলজির নোট নেবার জন্যে হয়ত কেনা হয়েছিল। বায়োলজির নানান প্রসঙ্গে খাতা ভর্তি। তার ফাঁকে-ফাঁকে অন্য সব কথা। হয়ত ফুসফুসের রক্ত সঞ্চালন সম্পর্কে দীর্ঘ একটা লেখার ফাঁকে চার লাইনের সম্পূর্ণ অন্য একটা লেখা।
জহির সারারাত জেগে লেখাগুলি পড়ল—
** জহির ভাইকে নিয়ে আজ মার সঙ্গে ঝগড়া হল। ঝগড়া হবার মতো কোনো ঘটনা ছিল না তবু হল। আসলে অন্য একটা ব্যাপারে আমি মার ওপর রেগে ছিলাম। সুযোগ পেয়ে রাগ ঝাড়লাম। মা খুব অবাক হলেন আমি জহির ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে এত কথা বলছি কেন? মাঝখান থেকে বেচারা জহির ভাই খুব সজ্জা পেলেন। আমার মনে হচ্ছে বেচারা আর অনেকদিন আমাদের বাসায় আসবেন না। এরকম ছোটখাট একটা ঘটনা ঘটে আর জহির ভাই সপ্তাহখানেক এ বাসায় আসা ছেড়ে দেন। আজকের সমস্যার সূত্রপাত হল এইভাবে-জহির ভাইকে বাজারে পাঠানো হয়েছিল, তিনি বাইম মাছ নিয়ে এসেছেন। সেই বাইম মাছ দেখে মা তাঁর স্বভাব মতো অগ্ন্যুৎপাত শুরু করলেন সাপের মতো দেখতে একটা মাছ তুমি কি মনে করে আনলে? কে খাবে এই মাছ?
আমি তখন বললাম, ওমাবাইম মাছ! আমার খুব ফেভারিট মাছ।
জহির ভাই আনন্দিত চোখে আমার দিকে তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে আমার বড় ভালো লাগল। আহা বেচারা! মা হতভম্ব। তিনি বললেন, বাইম মাছ তোর পছন্দ? তুই কবে খেয়েছিস?
আমি কখনো খাই নি তবু বুঝতে পারছি এ মাছ খেতে অসাধারণ হবে।
জহির ভাই বিব্রত গলায় বললেন, আমি বদলে নিয়ে আসছি।
আমি বললাম—অসম্ভব। আমি আজ বাইম মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছ খাবই না।
** তরু জহির ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন কথা বলছিল। ওরা বারান্দায় বসে কথা বলছিল। অবাক হয়ে দেখি তরুর গাল পাল, মাথা নিচু হয়ে আছে। আমার পায়ের শব্দ পেয়েই তরু থেমে গেল এবং চোখমুখ কেমন করে যেন তাকাল। তাকানোর এই দৃষ্টি আমি চিনি। আমি কেন, সবাই চেনে। শুধু গাধার গাধা জহির ভাই চেনেন না। কোনোদিন চিনবেনও না। আমি তরুকে ডেকে আমার ঘরে নিয়ে গেলাম। বললাম, জহির ভাইয়ের সঙ্গে কী কথা বলছিলি?
কোনো কথা বলছিলাম না তো।
কোনো কথা বলছিলি না?
ক্লাসের একটা মেয়ের কথা বলছিলাম।
কি কথা?
মেয়েটার নাম তৃষ্ণাও একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে—ছেলেটা ওদের আত্মীয়—ঐ গল্পটা বলছিলাম।
কেন?
কথায় কথায় চলে আসল–ওর কথা তোমাকেও তো বলেছি।
আমি হঠাৎ রুর গালে প্রচণ্ড চড় বসিয়ে দিলাম। এই কাজটা আমি কেন করলাম তরু কি তা বুঝতে পারল?