জহির লজ্জিত গলায় বলল, ফেলা হয় নি। সুন্দর ক্যালেন্ডার, ফেলতে মায়া লাগল।
এত মায়া করলে চলবে না জহির ভাই। খুব প্রিয় জিনিসকেও ছুঁড়ে ফেলার সাহস থাকতে হবে।
তুমি কী জন্যে এসেছ বল। মামা-মামীর শরীর ভালো?
হুঁ।
তাহলে?
অরু আপা আপনার কাছে কবে এসেছিল?
কেন বল তো?
আপনি আমার কথার জবাব আগে দিন। কবে এসেছিল?
দিন তিনেক আগে।
কেন?
তা দিয়ে তোমার দরকার কি?
আহা বলেন না।
কিছু টাকার জন্যে।
কত টাকা?
তা দিয়ে তোমার দরকার কি?
দরকার আছে জহির ভাই। খুব দরকার। আপা পালিয়ে গেছে।
জহির হতভম্ব হয়ে বলল, তোমার কথা বুঝলাম না। পালিয়ে গেছে মানে?
আজ বিকেলে আজহার সাহেব এসেছিলেন, তাকে দুলাভাই বলব কিনা বুঝতে পারছি না। উনি বললেন, একটা চিঠি লিখে অরু পালিয়ে গেছে।
কি লেখা চিঠিতে?
আমি কী করে জানব চিঠিতে কী লেখা, চিঠি তো আর সঙ্গে করে নিয়ে আসেন নি। আমরা জানতে চাই নি চিঠিতে কী লেখা।
তোমরা ভদ্রলোকের সঙ্গে কোনো কথা বললে না?
না। শুধু মা বলল, আপনি আমাদের কাছে এসেছেন কেন? আমরা ওর খবর আগেও রাখতাম না, এখনো রাখি না। তারপর ঐ লোকটা আপনার ঠিকানা চাইল। সেই ঠিকানাও আমরা দিলাম না।
দিলে না কেন?
আমি দিতে চাচ্ছিলাম কিন্তু বলার আগেই বাবা বললেন, জহিরের বাসা চিনি, ঠিকানা জানি না। লোকটা তখন আর কিছু না বলে চলে গেল। এরপর থেকেই বাসায় কান্নাকাটি চলছে। খুব খারাপ অবস্থা। এদিকে আবার মীরু…।
মীরু আবার কী করল?
আপনি আমার সঙ্গে একটু বাসায় চলুন তো।
চল যাই।
কে বলে বাসায় কোনো সমস্যা আছে।
সব স্বাভাবিক।
বরকত সাহেব উঠানে বসে পত্রিকা পড়ছেন। জহির এবং তরুকে মুখ তুলে একবার তাকিয়ে দেখলেন। মনে হচ্ছে খুবই জরুরি একটা খবর পড়ছেন। ওদের দিকে তাকিয়ে নষ্ট করার মতো সময়ও তার নেই।
জহির বলল, মামা ভালো আছেন?
বরকত সাহেব আবার তাকালেন। এবারো জবাব দিলেন না।
এসব কী শুনলাম তরুর কাছ থেকে?
নতুন কিছু শোন নি। নতুন কি শুনলে? অরু পালিয়ে গেছে এইতো শুনেছ? অরু কি আজ নতুন পালিয়েছে? আগেও তো পালিয়েছে। Itsnothingnew. একবার মানুষ যা করে, সেই জিনিসটাই সে বার বার করে। যাও ভেতরে যাও। Concerned হওয়ার কোনো দরকার নেই। সব ঠিকই আছে।
বরকত সাহেব স্বাভাবিক ভাব দেখাবার চেষ্টা করছেন।
ভেঙ্গে পড়েছেন শাহানা। সেই ভেঙ্গে পড়াটা অরুর কারণে না মীরুর কারণে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অরুর ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু মীরু কী করেছে?
মীরুর ঘরের দরজা বন্ধ। সেই ঘর অন্ধকার। কিছুক্ষণ পরপর ফুপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে।
জহির বলল, মামী মীরুর কী হয়েছে?
শাহানা খড়খড়ে গলায় বললেন, মীরুর তো কিছু হয় নি। মীরুর কথা কে তোমাকে বলেছে?
তরু বলছিল….
তরু কি পৃথিবীর সব জেনে বসে আছে? ওর জিহ্বাটা এত লম্বা কেন? কে তাকে বলেছে রাতদুপুরে তোমাকে ধরে নিয়ে আসতে? তুমি কে? তুমি করবেটা কি?
এত রাগ করছেন কেন মামী?
তোমার বোকামি দেখে রাগ করছি। তোমার মতে বোকা পুরুষ মানুষ দেখি নি। আমার কাছ থেকে তুমি যাও তো। তোমাকে দেখলেই রাগ লাগছে।
মামীর কথায় জহির রাগ করল না। একটা বড় রকমের সমস্যা যে হয়েছে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সমস্যার সময় কারোর মাথা ঠিক থাকে না। মেয়েরা নার্ভাস হয়ে অকারণ রাগারাগি করে।
জহির রাত দশটা পর্যন্ত থেকেও বিশেষ কিছু জানতে পারল না। বরকত সাহেব পত্রিকার পাতা চোখের সামনে মেলে আগের মতোই বসে রইলেন। জহির যখন বলল, মামা আমি কি থাকব না চলে যাব?বরকত সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, তোমার এখানে থাকার দরকারটা কি? তরু যে তোমাকে ধরে নিয়ে এসেছে তাতেই আমি রাগ করেছি। আমার সব কটা মেয়ে গাধা—শুধু গাধা না, গাধার গাধা।
তরু পাশেই দাঁড়িয়েছিল। বরকত সাহেব তাকেও প্রচণ্ড একটা ধমক দিলেন। এই ধমকের বিষয়বস্তু হল-গাধার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে জানালা বন্ধ করে রাখলে মশা ঘরে কম ঢোকে।
জহির চলে গেল।
জহির দুবার কলিং বেল টিপল।
মনে হয় আজহার সাহেব জহিরের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। দরজা খোলার আগেই বললেন, আসুন জহির সাহেব, আসুন। আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। জানতাম আপনি আসবেন। ধারণা ছিল আরো পরে আসবেন। রাত বারটা-একটার দিকে। আগেই এসে পড়েছেন। কেমন আছেন জহির সাহেব?
জ্বি ভালো।
বসুন। এই বিছানায় আরাম করে পা তুলে বসুন। আপনাকে অনেকক্ষণ থাকতে হবে। কথা আছে।
বলুন কি কথা।
বলব। সবই বলব, আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন ভাই? চা খান। দোকান থেকে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে এসেছি। চা খাব আর গল্প করব।
আগে ব্যাপারটি কি বলুন।
ব্যাপার কিছুই নেই। ব্যাপার খুব সিম্পল—অরু চলে গেছে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় লিপিস্টিক দিয়ে লিখেছে–
যে ভাবে এসেছিলাম।
সে ভাবে চলে গেলাম।
চারদিকে লিলুয়া বাতাস।
কাব্য করার একটা প্রচেষ্টা। ফাজলামি আর কি। লিলুয়া বাতাস কি জানেন?
না।
ডিকশনারিতে পাবেন না। লিলুয়া বাতাস মানে হচ্ছে যে বাতাস মানুষ নিয়ে খেলা করে, মানুষকে উদাস করে, বিষণ্ণ করে। মৈমনসিংহ গীতিকায় আছে। আমিই শিখিয়েছিলাম।
ও চলে গেল কেন?
জানি না ভাই। সত্যি জানি না। উদ্ভট-উদ্ভট কথা সে আমার সম্পর্কে অনেককে বলে—যেমন আমি এখানে তাসের আড্ডা বসাই, মদের আড়াবসাই, আজেবাজে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুর্তি করি। একটা কথাও ঠিক না। কেন সে এসব বলে তাও বুঝি না। আমি একজন শিক্ষক মানুষ। আজেবাজে সব কাণ্ডকারখানা ইচ্ছা থাকলেও আমি করতে পারব না।