অরু খায়, জহির চুপচাপ বসে থাকে।
আজ দুজনের কেউ-ই খাচ্ছেনা। দুজনই চুপচাপ বসে আছে। স্যুপমুখে দিয়ে আসমানী বলল, খেতে কেমন যেন ভাতের মাড়ের মতো লাগছে।
কথাটা শুনে জহিরের খুব ভালো লাগল। মেয়েটা বেশ মজার তো।
আসমানী বলল, গুলশান বাজারে যাবেন? গুলশান বাজারে হয়ত চকলেট কালারের শার্ট পাওয়া যাবে। বিদেশিদের মার্কেট তো। ওখানে সব কিছু পাওয়া যায়। আচ্ছা, আপনি কি কখনো গুলশান মার্কেটে গিয়েছেন?
না।
আমিও যাই নি। আমি শুধু শুনেছি।
বলতে বলতে অকারণ মনের আনন্দে আসমানী একটু হেসে ফেলল।
কি সুন্দর হাসি। হাসির সময় অনেক মেয়ের চোখ ছোট হয়ে যায় কিন্তু এই মেয়েটার সবই অদ্ভুত। এর চোখ বড় হয়ে যায়।
আসমানী?
কি?
এই খাবারগুলো খেতে তোমার একটুও ভালো লাগছে না, তাই না?
হ্যাঁ।
আমারও না। চল উঠে পড়ি। আসমানী বলল, টেবিল পরিষ্কার করে নিয়ে যাক তারপর আমরা খানিকক্ষণ কফি খেতেখেতে গল্প করব। কথাগুলি আসমানী খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল। যেন সে প্রায়ই এখানে আসে, প্রায়ই খাবার-টাবার শেষ করার পর কফি খায়। গল্প করে।
আসমানী।
জ্বি।
তুমি কি প্রায়ই এখানে আস?
না তো!
আমি কয়েকবার এখানে এসেছি। অরুর সঙ্গে। ওর আবার এইসব খাবার খুব আলো লাগে।
জহির লক্ষ করল, আসমানীকে এখন কেমন অন্যমনস্ক লাগছে। জহির বলল, আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি মানে এম্নি জিজ্ঞেস করা, তোমার ইচ্ছা না হলে জবাব দিও না।
আসমানী প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে বলল, আপনি কী বলতে চান আমি জানি যার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয়েছে কিনা—এই তো?
জহির খুবই অবাক হল। মাথা নিচু করে বলল, হ্যাঁ।
আসমানী বলল, না কোনোদিন দেখা হয় নি।
জহির বলল, তবে উনার ছবি তোমার কাছে আছে। তাই না?
আসমানী অস্পষ্ট স্বরে বলল, হা একটা ছবি আছে।
জহির বলল, ঐ ছবিতে উনার গায়ে নিশ্চয়ই চকলেট রঙের একটা শার্ট ছিল।
আসমানী শান্ত চোখে তাকিয়ে রইল। জহিরের কথার জবাব দিল না। জবাব দেবার কিছু নেই। কথাটা পুরোপুরি সত্যি। আসমানী ভেবে পেল না বোকা ধরনের এই মানুষটা এটা কী করে বুঝে ফেলল।
জহির বলল, চল যাওয়া যাক। অনেকক্ষণ বসে আছি। এঁরা হয়ত ভাবছেন।
আসমানী নিঃশব্দে উঠে দাঁড়াল, কিছু বলল না। সত্যি-সত্যি অনেকক্ষণ কেটে গেছে। বিকেল হয়ে গেছে। আকাশ মেঘলা। আজকের সকালটা খুব সুন্দর ছিল—এখন কেন জানি ভয়ঙ্কর খারাপ লাগছে। আসমানীর চেঁচিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। মন খারাপ, ভয়ঙ্কর মন খারাপ।
আসমানী বলল, আপনাকে সঙ্গে আসতে হবে না। আপনি থাকুন। আমি একা-একাই যাব। জহির বলব, তুমি কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ করেছ?
আসমানী জবাব দিল না। কিন্তু জহির দেখল আসমানীর চোখ ছলছ্ল করছে।
বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে
বারান্দায় কে যেন দাঁড়িয়ে।
লম্বা একজন কেউ এমনভাবে দাঁড়িয়ে যেন সে নিজেকে লুকাতে চাইছে। আগে বারান্দায় সারারাত পচিশ ওয়াটের একটা বাতি জ্বলতো—এখন জ্বলে না। সুইচে কি যেন গণ্ডগোল হয়েছে।
রাত প্রায় আটটা। দুটা টিউশানি শেষ করে ফিরতে-ফিরতে রাত সাড়ে নটার মতো বাজে, ভাগ্যিস আজ একটা বাড়িতে যেতে হয় নি। ছেলেটার গলাব্যথা, গলাব্যথা নিয়ে পড়বে না।
বারান্দায় পা দেয়ার আগেই জহির বলল, কে?
দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা যেন আরো একটু সরে গেল।
কে?
জহির ভাই, আমি তরু।
আরে রু। তুমি এখানে? কতক্ষণ ধরে আছ?
অনেকক্ষণ।
বল কি! দশটার আগে আসলে তো আমাকে পাওয়ার কথা না। ভাগ্যিস পেয়ে গেলে। আজ একটা ছেলে পড়ল না। ওর গলাব্যথা। তুমি…
কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না জহির ভাই। দরজা খুলুন।
জহির তালা খুলতে-খুলতে বলল, অপেক্ষা করার কোন দরকার ছিল না তরু। যখন দেখলে আমি নেই তখন একটা স্লিপ লিখে চলে গেলেই হত। তুমি স্লিপ লিখে চলে গেলেই আমি বাসায় চলে যেতাম।
আপনি এত বকবক করছেন কেন জহির ভাই। দরজাটা খুলুন না।
তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। চাবিটা কোথায় থাকে দেখ। আমার একটা চাবি সঙ্গে থাকে, আরেকটা চাবি জানালা খুলে একটু হাত বাড়ালেই পাবে। যদি কখনো এসে দেখ আমি নেই তখন হাত বাড়িয়ে চাবি নিয়ে দরজা খুলে ফেলবে। তখন আর কষ্ট করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না।
উফ আপনি এত কথা বলা শিখেছেন।
জহির লজ্জিত মুখে বলল, তোমাকে দেখে হঠাৎ এত ভালো লাগছে যে শুধু কথা বলতে ইচ্ছা করছে।
তরু চোখ বড়-বড় করে তাকাল। জহির বলল, কেউ তো আমার কাছে আসে। না। হঠাৎ যখন কেউ এসে পড়ে এমন ভালো লাগে।
তরু বিছানায় বসতে-বসতে বলল, আমি তো জানি অরু আপা মাঝেমাঝে আপনার এখানে আসে। তাই না?
তা আসে, কাজে আসে। এসেই বলে, চললাম। বড় অদ্ভুত মেয়ে।
অদ্ভুত এবং সুন্দর—তাই না জহির ভাই?
হ্যাঁ। সুন্দর তো বটেই। মনটাও ভালো। সুন্দর মেয়েগুলির মন সাধারণত একটু ছোট থাকে, ওর সে রকম না।
আমি এত রাতে আপনার জন্য কেন বসে আছি তা কি জানেন?
না।
তাহলে জিজ্ঞেস করছেন না কেন?
জহির দেখল তরুর চোখ ভেজা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এতক্ষণ হয়ত কাঁদছিল। জহির অভিভূত হয়ে গেল। কাউকে কাঁদতে দেখলে তার বড় খারাপ লাগে। জহির কোমল গলায় বলল, কি হয়েছে তরু?
তরু ঘরের চারদিকে তাকাতে-তাকাতে বলল, ইস ঘর-দের কী করে রেখেছেন। আমি এসে সুন্দর করে সাজিয়ে দেব। ঘরভর্তি এত ক্যালেন্ডার কেন? এই জিনিসটাই খারাপ লাগে। এ কি, গত বছরের ক্যালেন্ডারও দেখি আছে।