জহিরকে রাতের খাবার খেয়ে তারপর আসতে হল। আজহার সাহেব ছাড়লেন না। বললেন, আপনার বোনের রান্না যে কত খারাপ এটা টেস্ট না করে আপনাকে যেতে দেব না।
খাওয়ার টেবিলে আজহার সাহেব মজার-মজার গল্প বলতে লাগলেন। একটি গল্প রামকৃষ্ণ পরমহংসের। বানর-শিশু এবং বিড়াল-শিশুর গল্প। জহিরের খুব ভালো লাগল। আহা এই মানুষটা কত কিছু জানে। অরু কি গল্প শুনেশুনেই লোকটির প্রেমে পড়েছিল? শুধুমাত্র গল্প বলেই কি কেউ কাউকে ভোলাতে পারে?
নিশ্চয় পারে। না পারলে এই লোক কী করে ভোলালো? আধুবুড়ো একজন মানুষ। চুলে পাক ধরেছে। একটি চোখ ছোট আর একটি চোখ বড়। ঠোঁট দুটি ভারি। দাঁত অসমান। কিন্তু কথা যখন বলেন মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। কত রকম ক্ষমতাই না মানুষের থাকে।
জহির সাহেব।
জ্বি।
অরুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। আপনার জীবনের দুটি নাকি উদ্দেশ্য?
জহির অবাক হয়ে তাকাল। এ রকম কথা সে কখনো শোনে নি।
আজহার সাহেব বললেন, শুনলাম প্রথম উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যের সেবা করা এবং দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল অন্যের কাছ থেকে কোনো সেবা না নেয়া। এই যে এখন বিয়ে করছেন। আপনি কি আপনার স্ত্রীর কাছে থেকে কোনো সেবা নেবেন না?
অরু বিরক্ত গলায় বলল, খামাখা বক-বক করবে না। কথা বলার জন্যেই শুধু কথা বলা এটা আমার খুব অপছন্দ।
সরি। আচ্ছা জহির সাহেব?
জ্বি।
আপনাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি?
জ্বি করুন।
মজার ধাঁধা। এ দেশেরই একজন নৃপতির নাম বলুন যিনি সিংহাসনে বসেই হুকুম দিয়েছিলেন– যার গায়ে সামান্যতম রাজরক্ত আছে তাকে যেন হত্যা করা হয়। তিনি এটা করতে চাইলেন নিষ্কণ্টক করার জন্যে। তাঁর হুকুম অক্ষরে-অক্ষরে পালন করা হল। রক্ত-গঙ্গা বয়ে গেল। রাজা তখন প্রধান সেনাপতিকে বললেন, এমন কেউ কি আছে এখনো যার দেহে রাজরক্ত প্রবাহিত? প্রধান সেনাপতি বললেন–আপনার নিজের গায়ে রাজরক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, কাজেই আমি আপনার হুকুম মতোই আপনাকেও হত্যা করব। এই কাজেই এসেছি–বলেই প্রধান সেনাপতি রাজাকে হত্যা করলেন এবং যোষণা করলেন পৃথিবীতে আর রাজরক্ত বলে কিছু নেই। এখন জহির সাহেব আপনি বলুন ঐ রাজার নাম কি? এবং ঐ সেনাপতির নামইবা কি?
আমি জানি না। এ রকম অদ্ভুত গল্প আমি আজ প্রথম শুনলাম। রাজার নাম কি?
তা বলব না। আপনি খুঁজে বের করুন। এ রকম মজার মজার গল্প বলে আমি মানুষকে ইতিহাসের দিকে আকৃষ্ট করি। আমার টেকনিকটা চমৎকার না?
জ্বি চমৎকার।
খাওয়াদাওয়ার পর আজহার জহিরকে নামিয়ে দিতে চললেন। সাততলা ভেঙে নিচে নামার কোন দরকার নেই তবু তিনি যাবেনই। অরু বলল, জহির ভাই ওকে আপনার সঙ্গে যেতে দিনও সম্ভবত আপনাকে কিছু বলতে চায়। নয়ত ওর মতো অলস লোক সিঁড়ি ভাঙত না।
রাস্তায় নেমে আজহার বলল, সিগারেট খাবেন জহির সাহেব? যদি খেতে চান দুটি সিগারেট কিনুন। ডাক্তার আমার জন্য সিগারেট নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কাজেই আমি এখন নিজে সিগারেট কিনি না। অনন্য দিলে খাই। জহির দুটা সিগারেট কিনল।
জহির সাহেব?
জ্বি।
অরুর কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে মনে হয় আপনি কখনো মিথ্যা কথা বলেন। না। কথাটা আশা করি মিথ্যা না।
মিথ্যা বলার দরকার পড়ে না। দরকার পড়লে হয়ত বলব।
আসুন আপনার সঙ্গে একটু হাঁটি। হাঁটতে-হাঁটতে কথা বলি।
বলুন।
অরুর সঙ্গে আপনার কি খুব অন্তরঙ্গতা ছিল?
জ্বি না।
আজহার সিগারেটে একটি দীর্ঘ টান দিয়ে বললেন, জহির সাহেব, ওর সঙ্গে। আপনি কি কখনো ঘুমিয়েছেন?
আমি আপনার কথা বুঝলাম না।
না বোঝার মতো আমি তো কিছু বলছি নাHaveyou made love with her?
জহির চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে রইল। আজহার সাহেব অল্প হাসলেন। হাসতে-হাসতেই বললেন আপনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি এই জিনিস কখনো ঘটে নি। অরু কিন্তু আমাকে বলে। সম্ভবত আমাকে হার্ট করতে চায় বলেই বলে। আমি অবশ্যি সহজে হার্ট হই না। শারীরিক শুচিতা নিয়ে আমার খুব মাথাব্যথা নেই। আমার চেহারাটা ওল্ড ফ্যাশানড় তবে আমি মানুষটা ওল্ড ফ্যাশানড় নই। Iama modem man, জহির সাহেব।
জ্বি।
আপনি যখন ওদের বাসায় থাকতেন, কোথায় থাকতেন?
ওদের বসার ঘরে।
ভেতর থেকে ঐ ঘরের দরজা বন্ধ হয় না—তাই না?
জ্বি।
অরু সেই কথাই বলছিল। তার বর্ণনা, তার বলার ভঙ্গি সবই এত বিশ্বাসযোগ্য যে…আপনি কি বাসে যাবেন? যদি বাসে যান তাহলে এটাই বাসস্ট্যান্ড। বাসের জন্য অপেক্ষা করুন। আমি তাহলে যাই। আমি আপনার বিয়েতে থাকব। I will be there, অরু আসবে কি-না আমি জানি না।
আজকের সকালটা এত সুন্দর
আজকের সকালটা এত সুন্দর কেন?
ঘুম ভাঙতেই আসমানীর চোখ পড়ল আকাশেজানালার ফাঁক গলে ছোট্ট একটা আকাশ। কিন্তু এ আকাশ ছোট্ট না। বিশাল আকাশ। যে কোনো বিশাল কিছুর সামনে দাঁড়ালে মন কেমন করতে থাকে। শুধু আকাশের সামনে মন কেমন করে না, কারণ আকাশ দেখতে-দেখতে অভ্যেস হয়ে গেছে। তবে আজ আসমানীর মন কেমন করছে। কান্না-কান্না পাচ্ছে।
তার মামাতো বোন এসে বলল, আপু ঘুমুচ্ছ?
আসমানী চোখ বন্ধ করে রাখল। যেন সত্যি-সত্যি ঘুমুচ্ছে। সে কাউকে জানতে দিতে চায় না যে সে সারারাত ঘুমুয় নি। সারারাত জেগে কাটিয়েছে। বিদেশে থাকা ঐ ছেলেটির সঙ্গে তার যেদিন বিয়ে হল সেদিন রাতেও এই অবস্থা। সারারাত সে জেগে, এক ফোঁটা ঘুম নেই। অবশ্য ঐ রাতে সে একা না বাড়ির সবাই জেগে ছিল। সবাই নানা রকম ঠাট্টা-তামাশা করছিল। এর মধ্যে তার এক দূর সম্পর্কের ফুপাতো ভাই সাদা কাপড় পরে ভূত সেজে তাদের ভয় দেখাল। কত না কাণ্ড হল সেই রাতে। আহা ঐ বেচারা ফুপাতো ভাইটা বেঁচে নেই। পরের বছরই তিন দিনের জ্বরে মারা গেল। ও বেঁচে থাকলে আজও এসে কত হৈচৈ করত। ভালোভালো মানুষগুলো, যাদের হৃদয় আনন্দে পরিপূর্ণ, যারা সব সময় পৃথিবীর সবাইকে আনন্দ দিতে চায় তাদেরকে এত সকাল-সকাল পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয় কেন? ভাবতে-ভাবতে আসমানীর চোখ ভিজে উঠতে শুরু করল।