জহির কার্ড আগাতে-আগাতে বলল, স্যার আমার বিয়ের কার্ড।
সদরুল সাহেব না দেখেই বললেন, ভেরি গুড।
জহির হাত কচলাতে-কচলাতে বলল,মুরুী কেউ নেই স্যার। আপনিই মুরুী। আসবেন।
আসব, অবশ্যই আসব। অফিসসুদ্ধ দাওয়াত করেছ নাকি?
জ্বী না স্যার। টাকাপয়সার টানাটানি, অল্প কয়েকজনকে বলেছি।
সদরুল সাহেব ফাইলে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন। জহিরের দাঁড়িয়ে থাকা-না-থাকা এখন আর কোনো ব্যাপারই না। জহির ক্ষীণ স্বরে বলল, স্যার একটা ব্যাপারে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
সদরুল সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, পরে বললে হয় না? এখন খুব ব্যস্ত। ফাইল দিয়েছে দেড়টায়, বলেছে তিনটার মধ্যে ক্লিয়ার করতে—আরে আমি কি আলাউদ্দিনের দৈত্য নাকি?
জহির বলল, টাকাটার ব্যাপার মনে করিয়ে দেবার জন্য স্যার, বলেছিলেন বিয়ের আগে-আগে….
কিসের টাকা?
জহিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। সদরুল সাহেব এসব কী কথা বলছেন।
জহির বলল, আপনি নিয়েছিলেন স্যার।
ও আচ্ছা, Now I recall, দেখি কী করা যায়, কাল একবার মনে করিয়ে দিও, কত নিয়েছিলাম যেন, আট? আমি দশ ম্যানেজ করে দেব। বিয়েশাদীতে টাকাপয়সা বেশি লাগে।
জহির বিশেষ ভরসা পেল না। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, কাল কখন মনে করিয়ে দেব স্যার? এগারটার দিকে?
আমার এম্নিতেই মনে থাকবে তবু ইন কেইস যদি ভুলে যাই? তুমি বরং সাড়ে দশটার দিকে মনে করিয়ে দিও।
পরদিন সকাল সাড়ে দশটায় খবর নিয়ে জানা গেল সদরুল সাহেব আসেন নি। তিন দিনের ছুটি নিয়েছেন। ক্যাজুয়েল লিভ। জহিরের প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। বৌভাতের আইডিয়াটা বাতিল করা ছাড়া কোনো উপায় রইল না। কার্ড থেকে বৌভাত—আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারদুপুর দেড়টা—এই অংশ কেটে বাদ দিতে হচ্ছে। ওদের এগার শ টাকা এ্যাডভান্স দেয়া আছে। ঐ টাকা এখন ফেরত পাওয়া যাবে কি-না কে জানে। এ দেশে রিফান্ডেবল টাকা বলে কিছু নেই। যে টাকা একবার পকেট থেকে বের হয় সে টাকা আর ফেরত আসে না। জহির অফিস থেকে সদরুল সাহেবের বাসার ঠিকানা নিয়ে নিল। একবার যাবে ওদিকে। লাভ হবে না, তবুও যাওয়া।
অরুদের বাসাও ঐ দিকে, ওকেও একটা কার্ড দিয়ে যাওয়া দরকার। অরু অবশ্যি বিয়েতে আসবে না। সে এখন আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গে দেখা হয় এমন কোনো জায়গায় যায় না।
অরুরা থাকে সাত তলায়। উঠতে-উঠতে বুকে হাঁফ ধরে যায়, মাথা ঘুরতে থাকে। সবচে কষ্ট হয় যখন এর উঠবার পর দেখা যায় অরুরা নেই। আজ ছিল, কলিং বেল টিপতেই অরু দরজা খুলে দিল, বিরক্ত মুখে বলল, কি ব্যাপার? জহির বলল, সন্ধ্যাবেলা ঘুমুচ্ছিলে?
হ্যাঁ ঘুমুচ্ছিলাম। সন্ধ্যাবেলা ঘুমুনোযাবে না এমন কোন আইন নেই। জহির ভাই আপনি কোন কাজে এসেছেন, না লৌকিকতা?
আছে একটা ছোটখাট কাজ।
অরু হই তুলে বলল, কাজটা এখানে দাঁড়িয়ে সেরে ফেলা যায় না? ভেতরে ঢুকলেই আপনি কথাবার্তা বলবেন। শুধু-শুধু সময় নষ্ট। আমি দুরাত ঘুমুই নি।
জহির বিস্মিত হয়ে বলল, ঘুমাও নি কেন?
সত্যি-সত্যি জানতে চান?
হ্যাঁ।
হাইড্রোজেন খেলেছি।
হাইড্রোজেন খেলেছি মানে? হাইড্রোজেন আবার কী খেলা?
আপনি বুঝবেন না। কী বলতে এসেছেন বলে চলে যান। আমার ঘুম কেটে যাচ্ছে।
ঘরে আর কেউ নেই?
না।
আমি বরং বসার ঘরে চুপচাপ বসে থাকি, তুমি ঘুমাও। ঘুম ভাঙলে কথা বলব।
কথা বলতেই হবে?
হ্যাঁ।
বেশ তাহলে বসুন।
জহির বসে আছে। অরু ঘুমুতে গেল। এটা যেন কোনো ব্যাপারই না। অরু খুব গোছানো মেয়ে, অথচ ড্রইংরুমের অবস্থা কী করে রেখেছে। মনে হচ্ছে এক সপ্তাহ ঝাঁট পড়ে নি। একটা মুরগির হাড় অসংখ্য লাল পিঁপড়া টেনে-টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সোফার সাদা কাপড়ে কে যেন চা ঢেলে দিয়েছে, যা ধোয়ার কোনো চেষ্টাই করা হয় নি। টেবিলের উপর একটি ইংরেজি পত্রিকা। সেই পত্রিকায় বিশালবা একটি তরুণীকে দেখা যাচ্ছে। তাকাতে খারাপ লাগে আবার চোখ ফিরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করে না।
পুরোপুরি তিন ঘন্টা ঘুমুলো অরু। তিন ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকা খুব কষ্টের। আবার অরুকে কিছু না বলে চলে যাওয়া যাচ্ছে না। অরুর শোবার ঘরের দরজা খোলা। জহির বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে আবিষ্কার করল—অরু শুধু একটা শাড়ি দিয়ে শরীর ঢেকে রেখেছে। গায়ে ব্লাউজ বা কাঁচুলি কিছুই নেই। অরুর মতো মেয়ে এমন ভঙ্গিতে ঘুমুবে এটা কল্পনাও করা যায় না। জহির চেয়ার বদলে বসল যাতে অরুকে দেখতে না হয়।
ওমা সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সরি, অনেকক্ষণ ঘুমালাম। আরো অনেকক্ষণ ঘুমাতাম, মশা কামড়াচ্ছিল বলে ঘুসুতে পারলাম না। এমন মশা হয়েছে।
অরু জহিরের সামনের চেয়ারে বসে হাই তুলল। নিতান্ত স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনার বিয়ে তাই তো? পকেটে কার্ড দেখে বুঝতে পারছি। এটা বলার জন্যই এসেছেন?
হুঁ। বলে চলে গেলেই হত। খামাখা কষ্ট করলেন। বিয়েটা হচ্ছে কবে?
বার তারিখ।
ভালো কথা। বিয়ে করুন। বিয়ে করে দেখুন একটা মেয়ের সাথে ঘুমুতে কেমন লাগে।
জহির হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অরু এসব কী বলছে? ওর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে? হঠাৎ ঘুম থেকে উঠলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। উল্টা-পাল্টা কথা মনে আসে।
জহির বলল, আজহার সাহেব কোথায়?
জানি না কোথায়।
কখন আসবেন?
তাও জানি না। আসবে হয়ত একসময়। আবার নাও আসতে পারে। মাঝে মাঝে সে আসে না। আগের স্ত্রীর সঙ্গে ঘুমুতে যায়। ফরম্যাল ডিভোর্স তো হয় নি, রাত কাটাতে অসুবিধা নেই। আমাকেও ছাড়বে না ওর স্ত্রীকেও ছাড়বে না। আমও থাকবে আবার বস্তাও থাকবে, হি হি হি।