মোমবাতি আনতে দেরি হল। সেই মেয়েটিই মোমবাতি নিয়ে এসেছে। মোমবাতি টেবিলে বসাতে-বসাতে বলল, বাবা ওনাদের খাবার দেওয়া হয়েছে।
বরকত সাহেব বললেন, এখনই খাবার কি? কথাবার্তা বলি।
বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, খাবার বোধহয় বেড়ে ফেলেছে। এরা কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারে না। বললাম ঘন্টাখানিক পরে খাবার দিতে অন্ধকারের মধ্যেই দিয়ে বসে আছে। আসুন চারটা খেয়ে নেই। আসুন, ভেতরে আসুন। আরে গাধাগুলো কি বারান্দায় আলো দেবে না?
তিনজন খেতে বসলেন। জহির, তার মামা এবং বুড়ো এক ভদ্রলোক, যার নাম দিদার হোসেন। ইনিই মেয়ের বড় খালু। খাবার টেবিলের কোনা ঘেঁষে মাথা নিচু করে যে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তাকে একপলক দেখে জহির হতভম্ব। এই কি সেই মেয়ে। মানুষ এত সুন্দর হয়! এত স্নিগ্ধ চেহারা কারোর হয়? দ্বিতীয়বার তাকাবার সাহস তার হল না। যদি দ্বিতীয়বার তাকিয়ে দেখে আগের দেখায় ভ্রান্তি ছিল।
দিদার হোসেন বিরক্ত গলায় বললেন, কাঠের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন মা। মেহমানদের স্লামালিকুম দাও।
মেয়েটি ক্ষীণ স্বরে বলল, স্লামালিকুম।
দিদার হোসেন বললেন, এর নাম আসমানী। তুমি খাদিমদারি করে তো মা।
লোকজন খাওয়ানোয় মেয়েটি মনে হয় খুবই আনাড়ি। জহির প্লেটে হাত ধুয়েছে, সেই পানি না সরিয়েই আসমানী সেখানে এক হাতা পোলাও দিয়ে লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল।
দিদার হোসেন রাগী গলায় বললেন, এরা কোন একটা কাজ যদি ঠিকমত পারে। এই ছেলে কি পানিভাত খাবে? জহির আরেক পলক তাকাল মেয়েটির দিকে। বেচারির চোখে পানি এসে যাচ্ছে। জহিরের মনটা মায়ায় ভরে গেল। মেয়েটা জহিরের প্লেটটা সরিয়ে নিতে গেল। ধাক্কা লেগে একটা পানির গ্লাস উল্টে গেল।
দিদার হোসেন তিক্ত মুখে বললেন, এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গাধা। আসমানী তুই যা তো এখান থেকে।
মেয়েটি পালিয়ে বাঁচল। জহির বুঝতে পারছে রান্নাঘরে ঢুকে এই মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদবে। আহা বেচারি!
দিদার হোসেনের মেজাজ আরো খারাপ হল। কিছুক্ষণ পরপর ছোটখাট বিষয় নিয়ে তিনি হৈচৈ করতে লাগলেন, আচ্ছা লেবু কে কেটেছে। একটা লেবুও কি এরা ঠিকমত কাটতে জানে না? এইসব কী? এটা কি মানুষের বাড়ি না আস্তাবল?
রাত দশটায় ফেরার ঠিক আগে আগে বরকত সাহেব বললেন, মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমরা একটা আংটি নিয়ে এসেছি। আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আংটিটা আসমানী মার হাতে পরিয়ে দিতে পারি।
দিদার হোসেন আনন্দে অভিভূত হয়ে গেলেন। তাঁর চোখে অশ্রু চিকচিক করতে লাগল। যারা খুব সহজে রাগতে পারেন তারা খুব সহজে আনন্দিত হতে পারেন। দিদার হোসন গাঢ় স্বরে বললেন, এই মেয়েটাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। সে যে কত ভালো মেয়ে আপনারা যত দিন যাবে তত বুঝবেন। মেয়েটা দুঃখী। দুঃখী মেয়েটাকে আপনি সুখ দিলেন। আল্লাহ আপনার আলো করবে।
আংটি নেবার জন্যে মেয়েটা বসার ঘরে এল। জহিরের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকাতে। বড় লজ্জা লাগছে। কেউ না দেখে মত সে কি একবার তাকাবে?
জহির তাকাল। আশ্চর্য, মেয়েটিও তাকিয়ে আছে। কী গভীর মায়া, কী গভীর ভালবাসা মেয়েটির চোখে। চোখ দুটি ফোলা-ফোলা।
আহা বেচারি বোধহয় কাঁদছিল।
করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন
করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কিসের কার্ড জহির?
জহির কোনো শব্দ করল না। মাথা নিচু করে ফেলল। নিজের বিয়ের কার্ডের কথা মুখ ফুটে বলা যায় না, লজ্জা লাগে। করিম সাহেব খাম খুলতে খুলতে বললেন, বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে গেল?
জ্বি স্যার।
ঐ মেয়ে? মালিবাগ না কোথায় যেন থাকে বলছিলে?
যাত্রাবাড়িতে থাকে স্যার।
ও আচ্ছা যাত্ৰাবাড়ি। ভেরি গুড। খুবই খুশির সংবাদ।
মেয়ে স্যার ইন্টারমিডিয়েট পাস। হায়ার সেকেন্ড ডিভিশান পেয়েছে। পাঁচশ বিরাশি, ফোর্থ পেপার থাকলে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে যেত। সায়েন্স গ্রুপ স্যার।
ভালো, খুবই ভালো। বিয়ে কবে?
সামনের মাসের বার তারিখ। এই মাসেই হত—এই মাসটা আসমানীর জন্ম মাস।
মেয়ের নাম বুঝি আসমানী? জ্বি। ডাকনাম বুড়ি। আদর করে ছোটবেলায় ডাকতে-ডাকতে বুড়ি নাম হয়ে গেল।
জহিরের হয়ত আরো অনেক কথা বলার ছিল। বলা হল না। করিম সাহেব সময় দিতে পারলেন না। তাঁর হাতে অনেক কাজ। জহিরের শার্টের পকেটে আসমানীর একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি। তার খুব ইচ্ছা স্যারকে ছবিটা দেখায়। সেই সুযোগ হল না। করিম সাহেব বললেন, দেখ তো জহির ইদ্রিস এসেছে কি-না? ওকে ক্যালকুলেটারের ব্যাটারি আনতে পাঠালাম। এখন খোঁজ নেই। এদের বিন্দুমাত্র রেসপনসিবিলিটি যদি থাকে।
জহির দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ইদ্রিসের খোঁজে গেল। আসমানীর ছবি গত চারদিন ধরে সে পকেটে নিয়ে ঘুরছে। কাউকে দেখাতে পারছে না। কেউ দেখতে চাইলে দেখানো যায়। না চাইলে তো আর পকেট থেকে ছবি বের করা যায় না? তবু টিফিন টাইমে সদরুল সাহেবের সামনে পকেট থেকে কাগজ বের করার সময় এমনভাবে বের করল যে ছবিটা বেরিয়ে পড়ল। সদরুল সাহেব বললেন, বাহ্ সুন্দর মেয়ে তো! কে?
ব্যাস এই পর্যন্তই। একবার কে বলাতেই তো জহির হড়হড় করে সব বলে দিতে পারে না। চক্ষুলজ্জা আছে না?
কারোর কোনো উৎসাহ নেই। কেউ কিছু জানতে চায় না। বিয়ের কার্ডটা দেখেও কিছু বলে না।
জহির ভেবেছিল অফিসের সবাইকে দাওয়াত করবে। সেই ভাবনা বাতিল করতে হল। বৌভাত করবে; টাকা কোথায়? খাওয়াদাওয়া বাবদ আলাদা আট হাজার টাকা জমা করা ছিল। সেই টাকাটা এক মাসের কথা বলে টান্সপোর্ট অফিসার সদরুল সাহেব ধার নিলেন। পাঁচ মাস হয়ে গেল টাকাটা ফেরত পাওয়া যায় নি। এখন যদি না পাওয়া যায় তাহলে বৌভাত হবে না। সদরুল সাহেব কি দয়া করবেন? এ বিপদে টাকাটা তাকে ফেরত দেবেন?