- বইয়ের নামঃ দিনের শেষে
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস, কল্পকাহিনী
জহির লাজুক মুখে বলল
জহির লাজুক মুখে বলল, স্যার আজ একটু সকাল-সকাল বাড়ি যাব, একটা জরুরি কাজ।
বলতে গিয়ে কথা জড়িয়ে গেল, গলার স্বর অন্যরকম শোনাল। কথার মাঝখানে খুখুক করে কয়েকবার কাশল, নাকের ডগা ঈষৎ লালচে হয়ে গেল। হেডক্যাশিয়ার করিম সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন, ব্যাপারটা কি? জহির মাথা নিচু করে। অস্পষ্ট গলায় দ্বিতীয়বার বলল, একটা জরুরি কাজ।
করিম সাহেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। জরুরি কাজে বাড়িতে যাবে এটা বলতে গিয়ে লজ্জায় ভেঙে পড়ার অর্থ তিনি ধরতে পারলেন না।
জহির অবশ্যি এনিতেই লাজুক ধরনের ছেলে। লজ্জার সঙ্গে আরো একটা অস্বস্তিকর জিনিস তার মধ্যে আছে, যার নাম বিনয়। সেই বিনয়ও বাড়াবাড়ি বিনয়। হাইকোর্টের সামনে একবার জহিরের সঙ্গে দেখা, সে সাইকেলে করে কোথায় যেন যাচ্ছিল। করিম সাহেবকে দেখে আচমকা ব্রেক কষে নেমে পড়ল। বাকি পথটা সাইকেল টেনে পেছনে-পেছনে আসতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, তুমি পেছনেপেছনে আসছ কেন? যেখানে যাচ্ছ যাও। জহির বলল, অসুবিধা নেই স্যার। করিম সাহেব বুঝতে পারলেন এটা হচ্ছে জহিরের বিনয়ের একটা নমুনা। তিনি হেঁটে যাবেন আর জহির সাইকেলে তাকে পাস করে যাবে তা সে হতে দেবে না। তিনি বাধ্য হয়ে একটা রিকশা নিলেন, এবং জহিরের ওপর যথেষ্ট বিরক্ত হলেন। তিনি মিতব্যয়ী মানুষ। অকারণে টাকা খরচ করতে তাঁর ভালো লাগে না।
ক্যাশ সেকশনে জহির তিন বছর ধরে আছে। এই তিন বছরে জহিরের বিখ্যাত বিনয়ের সঙ্গে তাঁর অনেক পরিচয় হয়েছে। প্রতিবারই তিনি বিরক্ত হয়েছেন। শুরুতে তাঁর মনে হয়েছিল জহিরের লজ্জা এবং বিনয় দুইই এক ধরনের ভড়ং, যা প্রথম কিছুদিন থাকে; তারপর আসল মূর্তি বের হয়। ইউনিয়ন-টিউনিয়ন করে গায়ে চর্বি জমে যায়; তখন মুখের সামনে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে মেয়েমানুষ বিষয়ক রসিকতা করে হা-হা করে হাসে। জহিরের বেলায় এখনো তা হয় নি। কে জানে হয়ত তার চরিত্রই এরকম। অফিস ছুটির দশ মিনিট আগেও যদি তার হাতে একটা মোটা ফাইল ধরিয়ে বলা হয়, জহির, হিসেবটা একটু দেখে দাও তো। সে তৎক্ষণাৎ বলবে, জ্বি আচ্ছা স্যার। বিনয়ী এবং ভদ্রমানুষেরা কাজ-কর্মে সুবিধার হয় না। তারা সাধারণত ফাঁকিবাজ হয়। জহির সে রকম নয়। ক্যাশের কাজ-কর্ম সে শুধু যে বোঝে তাই নালোই বোঝে। করিম সাহেব তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেন।
আজ অফিসে কাজের চাপ আছে। ইয়ার এডিং, হিসাবপত্ৰ আপটু ডেট করতে হবে। করিম সাহেব, অডিট ঝামেলা করতে পারে এমন সব ফাইলগুলো আলাদা করে রেখেছিলেন, ভেবেছিলেন, ছুটির পরও কাজ করবেন। ক্ৰস চেকিং করবে জহির। অথচ বেছে-বেছে আজই তার সকাল-সকাল বাড়ি যেতে হবে। কোনো মানে হয়?
করিম সাহেব বললেন, তুমি কি এখনি চলে যেতে চাও?
জহির হাত কচলাতে লাগল। তার কানের ডগাও এখন ঈষৎ লাল। করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, ব্যাপার কী? জহির প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল, কিছু না স্যার।
বাড়িতে কোনো অসুখ-বিসুখ?
জ্বি না।
বলতে কি কোনো অসুবিধা আছে?
একটা বিয়ের ব্যাপার স্যার।
বিয়ে? কার বিয়ে?
জহির জবাব দিল না, ঘামতে লাগল। করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তোমার বিয়ে?
ঠিক বিয়ে না স্যার। মেয়ে দেখা।
তোমার জন্য?
জহিরের মাথা আরো নিচু হয়ে গেল। করিম সাহেব হাসিমুখে বললেন, এত লজ্জা পাচ্ছ কেন? এটা তো ভালো কথা। ইয়াং ম্যান বিয়ে করে সংসারী হবে, এ তো আনন্দের কথা। আজকাল ছেলেপুলেরা বিয়ে করতে চায় না। দায়িত্ব এড়াতে চায়। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টি-নষ্টি করবে অথচ বিয়ে করবে না।
জহির আগের ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে রইল। করিম সাহেব ফাইলপত্ৰ গুছাতে শুরু করলেন। জহির না থাকলে তাঁর থাকাও অর্থহীন। আজ তিনিও একটু সকাল-সকাল ফিরবেন। করিম সাহেব স্লয়ার বন্ধ করতে-করতে বললেন, মেয়ে কোথায় দেখতে যাবে?
যাত্ৰাবাড়িতে। মেয়ে ওর বড় চাচার সঙ্গে থাকে।
যাত্ৰাবাড়িতে অনেক দূর। যাবে কিসে? তোমার সাইকেলে করে নাকি?
জহির রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। করিম সাহেব বললেন, অফিসের গাড়ি নিয়ে যাও না কেন? অফিসের কর্মচারীরা বিশেষ-বিশেষ প্রয়োজনে গাড়ি নিতে পারবে এরকম নিয়মত আছে।
গাড়ি লাগবে না স্যার।
লাগবে না কেন? পাওয়া গেলেতো অসুবিধা কিছু নেই।
আমাকে দিবে না স্যার। গাড়ি অফিসারদের জন্যে।
দাঁড়াও আমি মোজাফফর সাহেবকে বলে দেখি। রিকশা করে মেয়ে দেখতে যাওয়া আর গাড়ি করে দেখতে যাওয়া তো এক না।
করিম সাহেব উঠে গেলেন। জহির খুবই অবাক হল। সে ভাবতেও পারে নি করিম সাহেব সত্যি-সত্যি তার জন্যে এতটা করবেন। তার ধারণা করিম সাহেব তাকে পছন্দ করেন না। গত বছর ইনক্রিমেন্ট সিস্টে তিনি তার নাম দেন নি। অফিসের মধ্যে একমাত্র তারই কোনো ইনক্রিমেণ্ট হয় নি। সে বড় লজ্জা পেয়েছিল।
করিম সাহেব যেরকম হাসি-খুশি মুখে ভেতরে গিয়েছিলেন সে রকম ফিরলেন না, ফিরলেন মুখ কালো করে। শুকনো গলায় বললেন, একটা গাড়ি নাকি গ্যারেজে, আর অন্য গাড়িটার ড্রাইভার নেই। বলতে-বলতে তিনি আরো গভীর হয়ে গেলেন। থমথমে গলায় বললেন, ড্রাইভার নেই এটা নিতান্তই ফালতু কথা। দিবে না এটা হচ্ছে কথা। জি. এম. সাহেবকে বলব। উনি একটা মিটিঙে আছেন।