মুহিব বলল, তুই নিজের চুল নিজে ছিঁড়েছিস। ভূতের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছিস।
নিজের মাথার চুল আমি নিজে কেন ছিঁডব?
পাগল বলেই ছিঁড়বি। যাই হোক, ওষুধ কিনে দিচ্ছি। ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে ভালো হয়ে যা।
ওষুধ যে কিনবে টাকা আছে?
আছে।
কোথায় পেয়েছ?
মুহিব জবাব দিল না। নাটকের শুটিং-এ দিনের টাকা দিনে দিয়ে দেয়। মুহিব চার হাজার টাকা পেয়েছে। ঢাক বাজিয়ে এই তথ্য জানাবার কিছু নেই।
রাস্তার ওপাশেই একটা ফার্মেসি দেখা যাচ্ছে। সে যাচ্ছে ফার্মেসির দিকে। অশ্রু তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে। অশ্রুকে কেন জানি খুব আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে।
ভাইয়া, ওষুধ কেনার পরেও কি তোমার কাছে টাকা থাকবে?
থাকতে পারে। এক জায়গা থেকে চার হাজার টাকা পেয়েছি।
যদি টাকা থাকে আমাকে একটা জিনিস কিনে দিবে?
কী জিনিস?
একটা বোরকা। বাইরে যখন যাই, পুরুষমানুষগুলা কেমন করে যেন তাকায়। এত বিশ্রী লাগে!
বোরকা কেনার মধ্যে আমি নাই।
প্লিজ ভাইয়া। প্লিজ।
মুহিব বিরক্ত মুখে নয়শ টাকা দিয়ে একটা বোরকা কিনল।
ভাইবোন বাসায় ফিরল রাত নটায়।
উঠানে বেতের চেয়ারে আলাউদ্দিন বসে আছেন। বারান্দায় বাতি জ্বালানো। বাতির আলোয় তার থমথমে মুখ দেখা যাচ্ছে। ছেলেমেয়েকে ঢুকতে দেখে তার মুখের চামড়া শক্ত হয়ে গেল। তিনি ছেলেকে কিছু জিজ্ঞেস না করে অশ্রুকে বললেন, কোথায় গিয়েছিলি? সত্যি কথা বলবি সত্যি কথা বললে ক্ষমা পারি। মিথ্যা বললো বটি দিয়ে গলা ফাঁক করে ফেলব।বল। কোথায় গিয়েছিলি?
অশ্রুঘলল, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম বাবা।
আলাউদ্দিন বললেন, টাং টাং ঘরে ঘুরছি আর মুখে বলছিস ভাক্তারের কাছে গিয়েছি। ফার্স্ট শো সিনেমা দেখে এসেছিস। সত্যি কথা বলা সত্যি কথা বললে ক্ষমা। সিনেমা দেখে এসেছিস।
অশ্রু বলল জি বাবা।
কোন হলে ছবি দেখেছিস বলাকা?
অশ্রুবলল, জি বাবা।
ছবির নাম কী?
অশ্রু হতাশাচোখেমুহিবের দিকে তাকালে আজ মিথ্যাদিবস বাধ্য হয়ে বোনের কারণে মুহিবকে বলতে হলো ছবির নাম, বাবা কেন আসামি।
আলাউদ্দীন অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ছবির নামা বাবা কেন আসামি?
অশ্রুর গলা পর্যন্ত কান্না চলে আসছে।অনেক কষ্টে কান্না আটকেবলল, জি বাবা।
ঠিক আছে, সামনে থেকে যাও। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া করে আমাকে বাধিত কর।
খাবার সময়ও আলাউদ্দিন অনেক ঝামেলা করলেন। ডিমের তরকারিতে লবণ। বেশি হয়েছে এই নিয়ে ঝামেলা। তিনি কঠিন গলায় কালেন, চিনি বেশি হলে খাওয়া যায়। লবণ বেশি হলে খাওয়া যায় না অশ্রুর মা, তুমি কি এই কথাটা জানো?
রাজিয়া জড়সড় হয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।
এত বছরেও যার লবণের আন্দাজ হয় নাই, তাকে কীশাস্তি দেয়া উচিত সেটা জানো? জবার দাও, জানো?
রাজিয়া ক্ষীণ গলায় বললেন, জানি না।
আলাউদ্দিন ঠান্ডা গলায় বললেন, কী করা উচিত। রাজিয়া বেগম আতঙ্কিত গলায়। এদিক-ওদিক তাকালেন। ছেলেমেয়ে কাউকেই আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। এই ভয়ঙ্কর কুৎসিত কথা কেউ শোনে নি। কিংবা কে জানে ঘরে বসে হয়তো শুনেছে। তাঁর চোখে পানি এসে গিয়েছিল তিনি সাবধানে। চোখের পানি মুছলেন।
মুহিব অশ্রুর ঘরে খাটের ওপর বসে ছিল। অশ্রু বলল, বাবা কী কথা বলেছে শুনেছ ভাইয়া?
মুহিব বলল, না। আমার কানে ফিল্টারের মতো আছে। যে সব কথা শুনতে চাই না, কান সেগুলি ফিল্টার করে বাইরে ফেলে দেয়।
তুমি সত্যি শুনতে পাও নি?
মুহিব জবাব দিল না। বাটি ভাঙার আওয়াজ আসছে। আলাউদ্দিন সম্ভবত গ্লাস বাটি ছুড়ে মারা শুরু করেছেন। রাগারাগির শেষ পর্যায়ে তিনি এই কাজ করেন।
অশ্রু বলল, ভাইয়া, রাতে আমার সঙ্গে কে ঘুমাবে?
মুহিব বলল, কেউ ঘুমাবে না। তুই একা ঘুমাবি।
ভাক্তার যে বলল একা না ঘুমাতে?
মুহিব বলল, ডাক্তার একা ঘুমাতে নিষেধ করেছেন, এদিকে আবার রবীন্দ্রনাথ বলেছেন একা ঘুমাতে। ডাক্তার বড় না রবীন্দ্রনাথ বড়?
রবীন্দ্রনাথ আবার কখন একা ঘুমাতে বললেন?
মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, একলা চল একলা চল রে। চলার বেলায় একলা, আবার ঘুমুবার বেলায়ও একলা—
একলা ঘুমাও একলা ঘুমাও একলা ঘুমাও রে
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে
তবে একলা ঘুমাও রে…
অশ্রু বলল, ভাইয়া, তোমার গানের গলা তো খুবই সুন্দর।
মুহিব বলল, তাতে সমস্যা কী?
অশ্রু বলল, তুমি কোনো একটা গানের স্কুলে ভর্তি হয়ে গান শিখ তো ভাইয়া।
মুহিব সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, শুধু গান না। নাচও শিখব। দাড়িগোঁফ কামিয়ে ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে খালি গায়ে হিজড়া নাচ দিব— এসো হে বৈশাখ।
অশ্রু হাসছে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি বন্ধ করার চেষ্টা করছে, পারছে না।
রাজিয়া ঘরে ঢুকে বললেন, তোরা খাবি না?
মুহিব বলল, বাবার রাগ কমেছে?
হ্যাঁ। ভাত খেয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে।
মুহিব বলল, তোমার প্রবেশ নিষেধ?
হ্যাঁ।
মুহিব বলল, ভালোই হয়েছে, তুমি অশ্রুর সঙ্গে ঘুমাবে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম— ডাক্তার বলেছেন রোগী যেন একা না শোয়।
রাজিয়া বললেন, রোগী মানে? অশ্রুর কী রোগ হয়েছে?
মুহিব বলল, অশ্রুর ভূতরোগ হয়েছে। খাটের নিচে যে ভূত দেখে এইটাই রোগ। মা, তাকে একটা বক্সখাট কিনে দিলে কেমন হয়! বখাটে খাটের নিচ বলে কিছু নেই, কাজেই ভূত বেচারার থাকার জায়গাও নেই। সে বাধ্য হয়ে বাবার খাটের নিচে আশ্রয় নেবে। মাঝরাতে বাবাকে ভয় দেখাবে।