মুহিব অবাক হয়ে বলল, আরেকটা ধরাব?
হুঁ। আরেকটা।
কেন?
নিলি বলল, আমি বিরক্ত হতে পছন্দ করি। আপনি আরেকটা সিগারেট ধরাবেন, তার ধোয়া আমার দিকে আসবে, আমি বিরক্ত হব। মজা না? নিলি আবারো খিলখিল করে হাসছে। হাসতে হাসতেই সে উঠে গেল। ডিরেক্টর সাহেব হাতের ইশারায় ডাকছেন। শট বুঝিয়ে দেবেন।
ডাক্তার খালেকের চেম্বারে মুহিব বোনকে নিয়ে বসে আছে। বেচারি ভয়ে অস্থির।
সে দুবার ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া, ভয় লাগছে।
ডাক্তার খালেকের শরীর ভারি। গলার স্বর ভারি। চশমার কাচ ভারি। তিনি তার বেয়ারাকে কঠিন কঠিন কথা নিচু স্বরে প্রায় ফিসফিস করে বলছেন। বেয়ারার হাতে চায়ের কাপ। হাত কাঁপছে বলে কাপ এবং পিরিচে ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। যে-কোনো মুহুর্তে পিরিচ থেকে কাপ পড়ে যাবে এমন অবস্থা।
করিম, তুমি যে ভুল করেছ সেই ভুল কি আর হবে?
হবে না স্যার।
একই উত্তর গতমাসে একবার দিয়েছ, বলেছ ভুল আর হবে না। বলেছিলে?
জি স্যার।
তার আগের মাসে একবার বলেছিলে, আর ভুল হবে না। বলেছিলে যে মনে আছে?
মনে আছে।
দানে দানে তিনদান। তিনদান হয়ে গেছে। এখন বিদায়! ক্লিনিকের ম্যানেজারের কাছ থেকে বেতন নিয়ে ভ্যানিস হয়ে যাও। ভ্যানিস বুঝ? ভ্যানিস মানে হাওয়া। আর যেন তোমাকে দেখতে না পাই।
জি আচ্ছা সার।
ভ্যানিস হবার আগে আমাদের তিনজনকে তিনটা লেবু চা দিয়ে যাও। চা ভালো হলে আবার চাকরিতে বহাল হবার ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।
করিম প্রায় ছুটে বের হয়ে গেল। এই অবস্থাতেও তার হাতে ধরা পিরিচ থেকে চায়ের কাপ পড়ল না। ডাঃ খালেক মুহিবের দিকে ফিরে বললেন, আপনার নাম মুহিব?
মুহিব বলল, জি স্যার।
আর এই মেয়েটির নাম অশ্রু। এই অশ্রুই কি খাটের নিচে ভূত দেখে? কি মা, তুমি ভূত দেখ?
অশ্রু হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
ডাঃ খালেক বললেন, নিলি টেলিফোনে আমাকে বিস্তারিত জানিয়েছে। ওর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। নিলি আছে কেমন?
মুহিব বলল, ম্যাডাম ভালো আছেন।
অভিনয় করে বেড়াচ্ছে?
জি স্যার।
ডাঃ খালেক অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন তোমার সঙ্গে কথাবার্তা। মা, বলো তুমি কি খুব ধর্মকর্ম কর?
মুহিব প্রশ্নের উত্তরে না বলতে যাচ্ছিল, তাকে চমকে দিয়ে অশ্রু বলল, জি স্যার।
পাঁচ ওয়াক্ত রেগুলার নামাজ ছাড়া আর কী পড়? তাহাজ্জুতের নামাজ পড়?
জি।
চাশতের নামাজ? সকাল এগারোটার দিকে পড়া হয়।
পড়তে চেষ্টা করি। যেদিন কোচিং খাকে সেদিন পড়তে পারি না।
ডাঃ খালেক বললেন, সিজিয়োফ্রেনিক রোগীদের অনেক লক্ষণের মধ্যে একটা হচ্ছে তারা হঠাৎ প্রবল উৎসাহে এবং আবেগে ধর্মকর্ম শুরু করে। নামাজ, রোজা, তসবি জপ।
মুহিব বলল, ও যে ধর্মকর্ম করে আমি জানতাম না স্যার। আমি কখনো দেখি নি।
ডাঃ খালেক বললেন, দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে এখন দেখি বেশির ভাগ পারিবারিক বন্ধন আলগী। পরিবারের এক সদস্য কী করছে অন্যরা তার খোঁজ রাখছে না। ছেলে ড্রাগ ধরেছে, বাবা-মা কিছুই জানে না। ভেরি স্যাড।
মুহিব বলল, জি স্যার।
ডাঃ খালেক হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, করিমকে চা দিতে বলেছি প্রায় আট মিনিট আগে। এখনো চা আসে নি।
মুহিব বলল, আপনার কথাবার্তায় সে খুব ভয় পাচ্ছিল তো, এইজন্যে ভুলে গেছে। প্রচণ্ড ভয় পেলে স্মৃতি এলোমেলো হয়। বাবা যখন আমাকে ধমকান, আমারও এরকম হয়। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা পাঁচটা সিগারেট নিয়ে আয়। আমি বাবার সামনে থেকে বের হই, সিগারেটের কথা ভুলে যাই।
ডাঃ খালেক অশ্রুর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমিও কি তোমার ভাইয়ের মতো বাবাকে ভয় পাও?
অশ্রু বলল, পাই স্যার।
তোমার বাবা কি তোমার খাটের নিচের ভূতের কথা জানেন?
জানেন।
উনি এই বিষয়ে কী বলছেন?
অশ্রু বলল, বাবা বলেছেন ভূত থাকবে ভূতের মতো, তুই থাকবি তোর মতো। সমস্যা কী?
ডাঃ খালেক বললেন, আমি তোমাকে বেশ কিছু ওষুধ দিচ্ছি। নিয়মমতো খেতে হবে। ভুল করা যাবে না। দশদিন পর আবার আসবে। এই দশদিনে কতবার ভূত দেখলে, ভূতটা কী করল, সব খাতায় লিখবে। তারিখ এবং সময়ও লেখা থাকবে। হাতের কাছে একটা খাতা নিয়ে ঘুমুতে যাবে। রাতে কোনো স্বপ্ন দেখে যদি ঘুম ভাঙে, সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নটা লিখে ফেলবে। স্বপ্ন হচ্ছে Short time memory. রাতের স্বপ্ন দিনে মনে থাকে না। এইজন্যেই রাতেরটা রাতে লিখে ফেলতে হয়। কী বললাম মনে থাকবে?
জি স্যার।
রাতে কি একা ঘুমাও।
জি।
একা ঘুমুবে না। কেউ-না-কেউ যেন রাতে তোমার সঙ্গে থাকে।
জি আচ্ছা।
মুহিব ভিজিট দিতে গেল। ডাঃ খালেক বললেন, নিলি আপনাকে পাঠিয়েছে, কাজেই ভিজিটের প্রশ্ন ওঠে না। নিলি আমার পেশেন্ট ছিল। তারও অশ্রুর মতো সমস্যা ছিল, তবে সে ভূত দেখত না। অচেনা এক লোককে তার ঘরে বসে থাকতে দেখত। যাই হোক বিদায়। দশদিন পর দেখা হবে।
মুহিব উঠে দাঁড়াল, আর তখনি করিম ট্রে নিয়ে ঢুকল। ট্রেতে চা আছে, নোনতা বিসকিষ্ট আছে। তিন গ্লাস পানি আছে।
ডাঃ খালেক করিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, চা নিয়ে বি সুপিড়। তোর চা এখন কে খাবে?
চেম্বার থেকে বের হয়ে অশ্রু বলল, ডাক্তারটা পাগলা আছে, তাই না ভাইয়া?
মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, পাগলের ডাক্তাররাও খানিকটা পাগল হন।
উনি পাগলের ডাক্তার।
হুঁ।
আমি কি পাগল?
অবশ্যই পাগল। পাগল না হলে কেউ খাটের নিচে ভূত দেখে?
অশ্রু বলল, তুমি ভুলে গেছ, ভূতটা টান দিয়ে আমার মাথার এক গোছা চুল ছিঁড়ে ফেলেছিল।