কোথায় শুটিং হচ্ছে বলো তো? আমি আসছি। শুটিং দেখব। আমি জীবনে কখনো শুটিং দেখি নি।
অসম্ভব। তোমার সামনে আমি কিছুই পারব না।
তোমার অভিনয় কেমন হচ্ছে?
মনে হয় ভালো। ডিরেক্টর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আমি মঞ্চকর্মী কি-না। এই থেকে মনে হলো ভালো হচ্ছে। লীলা, আমাকে ডাকছে। পরে কথা বলব। মনে হয় শট দিতে হবে।
শট দিতে হবে মানে কী?
একটা সিকোয়েন্স হবে। সিকোয়েন্সকেই এরা শট বলে। আমি ঠিক জানিও। লীলা রাখি?
ডিরেক্টর সাহেব সিকোয়েন্স বুঝিয়ে দিলেন। অন্ধ মেয়েটিকে আপনি রাস্তা পার করে দেবার জন্যে হাত ধরেছেন। মেয়েটি বলল, হাত ধরেছেন কেন?
আপনি বলবেন, রাস্তা পার করার জন্যে।
মেয়েটি বলবে, হাত ছাড়ুন, আমি নিজে নিজে রাস্তা পার হতে পারি।
এই বলে হাত ছাড়িয়ে সে নিজে নিজে রাস্তা পার হতে যাচ্ছে, তখন দেখা গেল দ্রুতগতিতে একটা ট্রাক আসছে। আপনি ভয়ে অস্থির হয়ে একবার ট্রাকের দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার মেয়েটির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি কাট না বলা পর্যন্ত অভিনয় ধরে রাখবেন। অভিনয় ছেড়ে দেবেন না।
মুহিব বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না স্যার। অভিনয় ধরে রাখব মানে কী?
যারা নতুন তাদের প্রধান সমস্যা, নিজের ডায়লগ বলার পরই তারা। এক্সপ্রেশন ছেড়ে দেয়। এটা করবেন না। বুঝেছেন?
জি স্যার।
দৃশ্যটা খুবই ভালো হলো। ডিরেক্টর বললেন, এক্সেলেন্ট। শুধু এক্সেলেন্ট বললেও কম বলা হবে। এক্সেলেন্টের ওপরে। তোমরা আমাদের নতুন অভিনেতা মুহিবের জন্যে একটা ক্ল্যাপ দাও।
সবাই ক্ল্যাপ দিল। ডিরেক্টর তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাতে ধরাতে মুহিবকে বললেন, সিগারেটের ব্যান্ড হেভিট কি আছে?
মুহিব জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করল। ডিরেক্টর প্রডাকশনের এক ছেলেকে (ছামছু না, অন্য আরেকজন) বললেন, মুহিবকে এক প্যাকেট সিগারেট দাও।
প্রডাকশনের ছেলে সিগারেট দিতে দিতে ফিসফিস করে বলল, ডিরেক্টর সারি আপনেরে ভালো পাইছেন। আপনার কপাল খুলল। চা খাবেন? চা দিব?
দাও।
হিরুইন আপনারে ডাকে। ঐ দেহেন, ইশারা করতেছে।
মুহিব সিগারেটের প্যাকেট হাতে এগিয়ে গেল। হিরোইনের নাম নিলি। তার গায়ের রঙ শ্যামলা। এই রঙেই তাকে সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে ফর্সা রঙ তাকে মানাত না। তার বয়স পঁচিশের ওপরে, কিন্তু দেখাচ্ছে সতেরো-আঠারো বছরের তরুণীর মতো।
নিলির মাথার ওপর প্রডাকশনের একটা ছেলে প্রকাও ছাতা ধরে আছে। নিলি বসে আছে ছায়ায়। তার পাশে একটা খালি চেয়ার আছে। মুহিব সেখানে বসল না। নিলি বলল, দূরে বসেছেন কেন? ছায়ায় এসে বসুন।
মুহিব বলল, আমি একটা সিগারেট ধরবি এইজন্যে দূরে বসেছি।
নিলি বলল, তাহলে ঠিক আছে। আমি সব সহ্য করতে পারি, দুটা জিনিস সহ্য করতে পারি না। সিগারেটের ধোয়ার গন্ধ আর কানের কাছে মশার ভনভন শব্দ। আমার এমনই কপাল, এই দুইয়ের অত্যাচার আমাকে সহ্য করতে হয়। ধরুন একটা ঘরে আমি আছি, আরো দুজন আছে। ঘরে যদি মশা থাকে, সেই মশা ঐ দুজনের কাছে যাবে না। আমার কানের কাছে এসে শুনন করতে থাকবে। আর ঐ দুজন যদি সিগারেট ধরায়, তাদের ধোয়া অন্য কোনো দিকে যাবে না। আসবে আমার কাছে। আপনি সিগারেট ধরাচ্ছেন না কেন?
মুহিব বলল, থাক, আপনার সামনে ধরাব না।
নিলি বলল, ধরান তো। আমি এখুনি প্রমাণ করব যে ধোয়া আমার দিকে আসবে।
মুহিব সিগারেট ধরাল। ধোয়া সত্যি সত্যি নিলির দিকে যাচ্ছে। নিলি খিলখিল করে হেসে ফেলল। মুহিব মনে মনে স্বীকার করল, এত সুন্দর হাসির শব্দ সে আগে কখনো শোনে নি। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে নকল হাসি হাসে। হাসার সময় ঢং করার চেষ্টা করে। তাদের হাসি হায়নার হাসির মতো হয়ে যায়। মুহিবের ধারণা, প্রতিটি তরুণী মেয়ের হাসির শব্দ রেকর্ড করে তাকে শোনানো উচিত। এতে যদি কিছু হয়।
মুহিব, আপনার বোন কেমন আছে?
ভালো আছে ম্যাডাম।
অশ্রু নাম, তাই না?
জি।
তাকে ডাক্তারের কাছে কবে নিয়ে যাবেন?
এখনো ঠিক করি নাই।
আজ তো সন্ধ্যার আগেই শুটিং শেষ হবে। আজই নিয়ে যান। আমি ডাক্তারের সঙ্গে আপয়েন্টমেন্ট করে দেই। দেব?
জি আচ্ছা।
নিলি হ্যান্ডব্যাগ খুলে টেলিফোন বের করল। অনেক সময় নিয়ে এসএমএস টাইপ করে পাঠিয়ে দিল। টেলিফোন ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, আটটার আগে চলে যাবেন। গ্রীনরোড়ে তার চেম্বার। ৩৮ গ্রীনরেড়ি। চেম্বারে সাইনবোর্ড আছে–নিরাময়। ডাক্তার সাহেবের নাম খালেক। মনে থাকবে?
থাকবে।
আমার অন্ধের অভিনয় কেমন হয়েছে?
ভালো হয়েছে।
দর্শক যখন দেখবে তখন কি তাদের মনে হবে এই মেয়েটা সত্যি অন্ধ?
মুহিব বলল, মনে হবে না।
নিলি বলল, কেন মনে হবে না?
কারণ আপনি বিখ্যাত অভিনেত্রী। সবাই আপনাকে চেনে। আপনি যাই করেন সবাই ধরে নেবে অভিনয় করছেন। তবে যারা আপনাকে চেনে না, তারা অন্ধ মেয়ে ভাববে। অবশ্যই ভাববে।
এত জোর দিয়ে অবশ্যই কেন বলছেন? আমাকে খুশি করার জন্যে?
জি-না ম্যাডাম। আমি হিমু গ্রুপের মানুষ। হিমু গ্রুপের মানুষ কাউকে খুশি করার জন্যে কিছু করে না।
নিলি বলল, হিমুর ব্যাপারটা আমি জানি। উপন্যাসের একটা চরিত্র। একে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার কিছু নেই।
ম্যাডাম, মানুষের নিয়ম হচ্ছে, গুরুত্বহীন বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া। আর গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলি পাশ কাটিয়ে যাওয়া।
নিলি বলল, হতে পারে। আপনার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে, আরেকটা ধরান তো।