মহিব সাবান কিনে আনল। মেয়েটা সারা গায়ে সাবান ডলে লেকের পানিতে গোসল করল। মুহিবকে বলল, আপনি আশেপাশে থাকুন। আমি সাঁতার জানি না। পা পিছলে বেশি পানিতে পড়ে গেলে টেনে তুলবেন। আর বইটা ধুয়ে ফেলুন। বইটা আমার মা আমার পঞ্চম জন্মদিনে দিয়েছিলেন। এটা তার স্মৃতিচিহ্ন। আমি যেখানেই যাই এই বই সঙ্গে থাকে। বইটার দ্বিতীয় পাতায় আমার মায়ের লেখাটা মুছে গেছে কি-না দেখুন তো।
মুহিব পাতা উল্টাল। নর্দমার নোংরা বইটার মলাটে লেগেছে। ভেতরটা ঠিক আছে। দ্বিতীয় পাতায় লেখা–
লীলাবতী মা মণি!
বড় হয়ে এই বইটা পড়বে। ঠিক আছে মা?
চাঁদের কণা। লক্ষ্মী সোনা। ঘুটঘুট। পুটপুট।
আমার মা হুটহুট।
মুহিব বলল, আপনার নাম লীলাবতী?
লীলা গায়ে সাবান ডলতে ডলতে বলল, হুঁ।
মুহিব বলল, আপনার মা লিখেছেন— আমার মা হুটহুট। হুটহুট মানে কী?
হুটহুটের কোনো মানে নেই। এটা হলো Nonsence Rhyme.
ননসেন্স রাইমটা কী?
লীলা বলল, ননসেন্স রাইম হলো অর্থহীন ছড়া। কোনো অর্থ হবে না, কিন্তু ভালো লাগবে। অন্তমিল থাকবে, ছন্দ থাকবে।
লীলার পা ভালোই কেটেছিল। দুটা স্টিচ লাগল। ডাক্তার ধনুষ্টংকারের ইনজেকশন দিলেন। অ্যান্টিবায়োটিক দিলেন। মুহিব লীলাকে তার বাসায় পৌঁছে দিল। লীলা বলল, আজ আপনি বাসায় ঢুকবেন না। আগামীকাল ঠিক এই সময় আসবেন।
মুহিব বলল, আগামীকাল আসব কেন?
লীলা বলল, দরকার আছে। অবশ্যই আসবেন।
মুহিব পরদিন গেল। লীলা গাভর্তি গয়না পরে বসে আছে। তাকে দেখাচ্ছে ইন্দ্রাণীর মতো। লীলা বলল, আমার গায়ের সব গয়না হলো আমার মার। বিশেষ বিশেষ দিনে আমি আমার মায়ের গয়না পরে বসে থাকি।
মুহিব বলল, আমাকে আসতে বলেছেন কেন?
লীলা বলল, ধন্যবাদ দেবার জন্যে। গতকাল ধন্যবাদ দেয়া হয় নি। বসুন।
মুহিব বসল। লীলা বলল, বাবা বাসায় থাকলে ভালো হতো। বাবার সামনে ধন্যবাদ দিতে পারতাম। বাবার আজই একটা জরুরি কাজ পড়ে গেল।
লীলা হাতে একটা কাগজ নিয়ে পড়তে শুরু করল–
আমি এখনো আপনার নাম জানি না। আপনি আমার নাম জানেন। আপনি কিছুটা এগিয়ে আছেন। নর্দমায় পড়ে যাবার মতো হাস্যকর একটি ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে। আপনি আমাকে টেনে তুলেছেন। এটি চোরাবালি থেকে টেনে তোলার মতো বড় কোনো উদ্ধারকর্ম না। তারপরেও যে স্বাভাবিকতার সঙ্গে কাজটি আপনি করেছেন তা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আপনাকে লিখিতভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ, ধন্যবাদ।
মুহিব বলল, আপনি তো বিরাট নাটক শুরু করেছেন।
লীলা বলল, নাটক এখনো শেষ হয় নি। এখন আমার মা যে কবিতার বইটা দিয়েছেন, সেখান থেকে একটা কবিতা পাঠ করে শোনানো হবে। আপনার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না, কবিতা আপনার পছন্দের বিষয়। তারপরেও শুনতে হবে।
God once declared he was true
And then took the veil and withdrew,
And remember how final a hush
Then descended of old on the bush.
লীলা বলল, কিছু বুঝতে পারলেন।
মুহিব বলল, না।
লীলা বলল, বুঝতে না পারলে লজ্জিত বোধ করার কিছু নেই। এই কবিতাটা খুব সহজভাবে লেখা অত্যন্ত কঠিন একটা কবিতা। এখন বলুন, আপনার নাম কী?
মুহিব।
আপনার মোবাইল টেলিফোনের নাম্বারটা আমাকে দিন। টেলিফোনে আরো একদিন আসতে বলব, বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যে।
আমার কোনো মোবাইল টেলিফোন নেই।
নেই কেন? মোবাইল ব্যবহার পছন্দ করেন না বলে নেই, না-কি টাকা নেই বলে নেই?
মুহিব বলল, টাকা নেই বলে নেই।
লীলা তার সেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, রেখে দিন, এটা আপনার। আমি আরেকটা কিনে নেব। নিতে বলছি নিন। আর শুনুন, আমি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী। ইংরেজিতে আপনি, তুই নেই। সবাই তুমি। এখন থেকে আপনাকে আমি তুমি করে বলব। আপনিও আমাকে তুমি বলতে পারেন। তুমি বলতে অস্বস্তি বোধ করলে আপনি বলতে পারেন।
মুহিব বলল, আমি এখন উঠি?
লীলা বলল, না। তুমি দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে। আমি রান্না করেছি। আমি রাঁধতে পারি না। ডিমভাজি করেছি আর ডাল। বুয়া কৈ মাছ রান্না করেছে। আমি চাই আমার রান্না আজ খাবে। বাথরুমে যাও, হাতমুখ ধুয়ে আস। ঐদিকে বাথরুম।
মুহিব দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। বাথরুমে ঢুকে পড়ায় লীলা নামের অদ্ভুত মেয়েটা মুহিবের দুর্বলতা ধরতে পারল না।
বৃষ্টি এখনো পুরোপুরি কমে নি। তবে আগের মতো পড়ছে না। টিপটিপ করে পড়ছে। মুহিব বের হয়ে পড়ল। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, এই বৃষ্টি আজ সারাদিনেও কমবে না। চায়ের দোকানে বন্দি হয়ে থাকার কিছু নেই।
সামান্য এগুতেই বড় বড় ছাতা হাতে কিছু লোকজনকে দেখা গেল। অতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে তারা ছোটাছুটি করছে। মুহিব এগিয়ে গেল। বেকার মানুষদের কৌতূহল বেশি থাকে। কৌতূহল মেটানোর অবসরও তাদের আছে।
নাটকের শুটিং হচ্ছে। সব রেডি করা আছে। বৃষ্টি পুরোপুরি থামলেই শুটিং শুরু হবে। নায়িকা প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসা। তার মাথার ওপর সী বিচের প্রকাও ছাতা ধা। সেই ছাতার রঙও লাল। ছাতা এমনভাবে ধরা যেন নায়িকার মুখ দেখা না যায়। মুহিব ছাতা হাতে নিয়ে ছোটাছুটি করছে এমন একজনকে বলল, ভাই নাটকের নাম কী?
নাটকের লোকজন দর্শকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেয় না। এই লোক দিল। ভদ্রভাবে বলল, এই বসন্তে। ভ্যালেনটাইন দিবসের নাটক।