শওকতের মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হলো। তিনি মুহিবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, দরজায় দাঁড়িয়ে তো ওষুধ দেয়া যায় না। ভেতরে এসে বসো। হোমিওপ্যাথি কঠিন বিদ্যা। এলোপ্যাথির মতো না যে, অসুখ হলো, কী অসুখ বলার আগেই ডাক্তার অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিল। অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ পড়া মাত্র কী হয় জানো?
কী হয়?
আমাদের লোয়ার ইনটেশটাইনের সব উপকারী জীবাণু মরে সাফ হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়া।
মুহিব বলল, উপকারী জীবাণু আছে নাকি?
শওকত বললেন, অবশ্যই আছে। They are our friends. আমরা কী করি অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে বন্ধুদের মেরে ফেলি। What a pity! এসো, ভেতরে এসো। সোজা আমার স্টাডি রুমে চলে যাও। আমি কেইস স্টাডির খাতাটা নিয়ে আসি। তোমার মায়ের নাম রাজিয়া বেগম। তাই না?
জি চাচা।
স্টাডি রুমে মুহিব এবং শওকত সাহেব। দুজনে মুখোমুখি বসা। শওকত সাহেবের হাতে পাঁচশ পাতার চামড়ায় বাঁধানো মোটা খাতা, চামড়ায় সোনালি রঙ দিয়ে লেখা
Case Study Book
S. Chowdhury
শওকত বললেন, এই যে পাওয়া গেছে। পেশেন্টের নাম রাজিয়া বেগম। বয়স পঞ্চাশ। মিডিয়াম হাইট। গাত্রবর্ণ গৌর। ঠিক আছে?
মুহিব বলল, জি চাচা।
শওকত খাতা পড়তে পড়তে বললেন, পানি পানে অনীহা। অম্ল ভোজনে আগ্রহী। নিদ্রায় সমস্যা। ঠান্ডার ধাত।
মুহিব বলল, সব ঠিক আছে চাচা।
শওকত বললেন, এক বছর আগের এন্ট্রি তে। এর মধ্যে কিছু Change হতে পারে। সেজন্যেই জিজ্ঞেস করছি। আপটুডেট থাকা দরকার। আছে কোনো চেঞ্জ?
মুহিব বলল, রাগ মনে হয় সামান্য বেড়েছে। আগে কারো সঙ্গেই রাগারাগি করতেন না। এখন বাবার সঙ্গে করেন।
শওকত বললেন, কী লিখব? খিটখিটে মেজাজ?
মুহিব বলল, খিটখিটে মেজাজ বলা ঠিক হবে না। মা খুবই শান্ত স্বভাবের। বাবার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছে না। আগেও হয় নি। তা নিয়ে মা কিছু বলতেন না, এখন বলেন।
শওকত বললেন, সমস্যা কী বলে?
মুহিব বলল, আধকপালি মাথাব্যথী।
ডান দিক না বাঁ দিক?
ডান বামের জন্যে ওষুধ আলাদা হবে?
অবশ্যই। হোমিওপ্যাথি যে কত জটিল চিকিৎসা তোমাদের কোনো ধারণা নেই। আইনের ব্যাখ্যার চেয়েও জটিল। যাই হোক, তুমি রান্নাঘরে চলে যাও। আমাকে এককাপ চা বানিয়ে দিয়ে যাও। কাজের মেয়েটা দুদিনের ছুটি নিয়ে গেছে। আজ দশদিন। বিরাট ঝামেলায় পড়েছি।
রান্নাবান্না কে করে?
লীলা যা পারে করে। আমি নিজেও কয়েকদিন ভাত রান্না করলাম। ভেরি ডিফিকাল্ট জব। আতপ চাল রান্নার এক রেসিপি, আবার সিদ্ধচাল রান্নার অন্য রেসিপি। পুরনো চাল একভাবে ব্লাঁধতে হয়, আবার নতুন ধানের চাল অন্যভাবে। রাইস কুকার ছিল। ইনস্ট্রাকশন ম্যানুয়েল হারিয়ে ফেলেছি বলে সেটাও ব্যবহার করতে পারছি না।
মুহিব চা বানাতে গেল। রান্নাঘরের অবস্থা ভয়াবহ। বেসিনভর্তি আধোয়া বাসনপত্র। মেঝে নোংরা হয়ে আছে। মুহিব চা বানিয়ে দিয়ে এসে বাসনপত্র ধুয়ে পরিষ্কার করল। মেঝে মুহুল! পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে সে যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছে। তার মনে হলো, বাসাবাড়িতে চাকরের কাজ নিলে তার জব স্যাটিসফেকশনের সমস্যা হতো না।
লীলার শোবার ঘর হাট করে খোলা। মুহিব সেই ঘরও ঝাট ছিল। বিছানার চাদর বদলে দিয়ে বালিশের ওপর গতরাতে লেখা চিঠি রেখে দিল। সে এ বাড়িতে এসেছিল লীলাকে চিঠিটা দিতে। মুহিব লিখেছে–
লীলা,
পরশু রাতে আমাদের বাসায় একটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা তোমাকে জানাবার জন্যেই চিঠি। ইদানীং কালে আমার এই সমস্যা হয়েছে। বাসায় যা-ই ঘটে তোমাকে জানাতে ইচ্ছা করে। আমি জানি এটা মেয়েলি স্বভাব। মেয়েরাই ঘরের কথা প্রিয়জনদের জানাতে আগ্রহ বোধ করে। ছেলেরা তেমন করে না।
যাই হোক, ঘটনাটা বলি। বাবা মার ওপর কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে রাগ করেছেন। রাগ করে তিনি মাকে অতি নোংরা কিছু বললেন। আমার বাবা এমএ পাশ একজন মানুষ। স্কুলের রিটায়ার্ড হেডমাস্টার। এবং একজন গীতিকার। তোমাকে আগে বুলি নি, বাবা কিন্তু বাংলাদেশ বেতারের একজন এনলিস্টেড গীতিকার। তাঁর অসাধারণ প্রেমের গান তুমি হয়তো শুনেছ—
চাঁদবদনী সুজন সখি
নিশি রাইতের পাখি
কেন করে ডাকাডাকি?
মহান প্রেমসঙ্গীত রচয়িতা বাবা মাকে নোংরা কথা বলেই ক্ষান্ত হলেন না। তিনি বললেন, এক্ষুনি বাসা থেকে বের হ। এই মুহূর্তে।
মা ভেতরের বারান্দায় পেয়ারা গাছের নিচে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তুমি তো কখনো আমাদের বাসায় আস নি। আমরা উত্তরখান বলে শহরের বাইরে থাকি। চারকাঠা জমিতে টিনের বাড়ি। নেংটির বুকপকেটের মতো বাড়িটার নাম রাজিয়া মহল। রাজিয়া আমার মায়ের নাম। আমাদের বাসাটা বেশ বড়। ভেতরের দিকের উঠানে অনেকখানি জায়গা। বড় একটা পেয়ারা গাছ এবং কাঁঠাল গাছ আছে। দুটা গাছের কোনোটাতেই কখনো ফল ধরে না।
রাত এগারোটার দিকে বাবা শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমুতে গেলেন, তখন আমি মার কাছে গেলাম। শান্ত গলায় বললাম, মা, ঘরে চল। আমার সঙ্গে ঘুমুবে।
মা বললেন, না।
সারারাত পেয়ারা গাছের নিচে হাঁটাহাঁটি করবে?
মা জবাব দিলেন না। আমি মাকে পাজাকোলা করে তুললাম। মা বললেন, কী করিস, ফেলে দিবি তে!
আমি বললাম, ফেলব না।
রাতে মা আমার ঘরে থাকলেন। আমার ঘরের খাটটা ছোট। তাকে খাটে শুইয়ে আমি মেঝেতে পাটি পেতে ঘুমালাম। গল্পটা এখানেই শেষ না। সকালবেলা বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। তিনি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন না। ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলেন। এবং কথা বলার সময় হেডমাস্টারের মতো গলা বের করেন।