আহসান বলল, লীলার সঙ্গে আমার পরিচয়ের শুরুটা কি জানেন? আপনাদের পরিচয়ের শুরুটা জানি। নর্দমায় পরিচয়। আমাদের সেরকম না। তবে সেই পরিচয়ও ইন্টারেস্টিং। বলব?
বলুন।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ রাস্তার একটা নেড়ি কুকুর আমাকে তাড়া করল। ভয়ে এবং আতঙ্কে অস্থির হয়ে একটা খোলা গেট দেখে ঢুকে পড়লাম। ততক্ষণে কুকুরটা আমাকে কামড়ে ধরেছে। সেই বিশাল বাড়ির বারান্দায় অতি রূপবতী এক বালিকা কী যেন করছিল। আমি আশ্রয়ের জন্যেই বোধহয় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে অজ্ঞান হয়ে পড়লাম। কুকুরটা আমাকে কামড়াল। মেয়েটাকে কামড়ালি। মেয়ের মা আমাদের উদ্ধার করতে এলেন, তাকেও কামড়াল। ঐ মেয়েই লীলা।
লীলার মা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন?
আহসান বলল, হ্যাঁ। উনি বলতেন, পাগলা কুকুর তাড়া করে আমার মেয়ের জামাইকে আমার ঘরে ঢুকিয়েছে।
মুহিব বলল, লীলার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের গল্পটা খুব সুন্দর।
আহসান বলল, গল্পটা চমৎকার, কারণ গল্পটা মিথ্যা। লীলার সঙ্গে প্রথম দেখার অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত সিনারিও আমি কল্পনা করি। তারই একটা আপনাকে বললাম। আবার যেদিন দেখা হবে সেদিন আরেকটা বলব। আপনার সঙ্গে আমার কিছু মিলও আছে। আপনি যেমন গভীর রাতে লীলাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন, আমিও থাকি। তফাত একটাই, আপনি থাকেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে, আমি থাকি দামি গাড়ির ভেতর। চলুন আপনাকে লীলার কাছে দিয়ে আসি।
ব্রাউন পেপারে মোড়া টাকা
ব্রাউন পেপারে মোড়া টাকা টেবিলের ওপর রাখা। মুহিব সালমার বাবা আশরাফ সাহেবকে বলল, টাকাটা নিয়ে এসেছি। আপনি পাঁচ লাখ চেয়েছেন, এখানে চার লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে। বাকিটা আমি এক মাসের মধ্যে দেব।
আশরাফ কিছুক্ষণ ব্রাউন পেপারের দিকে তাকিয়ে বিভূবিড় করে নিজের মনে কী যেন বললেন। ভদ্রলোকের ভাবভঙ্গি, চোখের দৃষ্টি সবই প্রতিবন্ধীদের মতো। তিনি এখন তাকিয়ে আছেন তার সামনে রাখা গ্লাসভর্তি সবুজাভ পানীয়ের দিকে। গ্লাসের পাশে পিরিচে একটুকরা লেবু কাটা। তিনি বললেন, গ্লাসে আছে চিরতার পানি। ভোরবেলা খালি পেটে একগ্লাস চিরতার পানি খেয়ে লেবু দিয়ে মুখশুদ্ধি যে করে তার রোগবালাই হয় না।
মুহিব বলল, ও।
আশরাফ বললেন, আরেকটা মহৌষধ হলো কালিজিরা। হাদিসে আছে— মৃত্যুরোগ ব্যতীত সর্বরোগের মহৌষধ কালিজিরা।
মুহিব বলল, চাচা, টাকাটা রাখুন। আপনি বলেছিলেন মামলা তুলে নিবেন। আপনাকে আর আপনার মেয়েকে কোর্টে যেতে হবে। আমি টেক্সিক্যাব নিয়ে এসেছি।
আশরাফ মুহিবের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি আমাকে খারাপ ভাবছ?
মুহিব বলল, জি-না।
আশরাফ বললেন, মুখে না বললেও মনে মনে অবশ্যই ভাবছ। তবে বাবা শোন, আমি কিছুদিন সৌদিতে ছিলাম। সেখানে দেখেছি টাকার বিনিময়ে অপরাধ ক্ষমা করা হয়। কেউ যদি খুনও করে, রক্ত ঋণ দিলে তারও ক্ষমা হয়। এই কারণেই তোমার কাছে টাকা চেয়েছিলাম। আমি অতি দরিদ্র ব্যক্তি। ভিক্ষুকের কাছাকাছি।
মুহিব বলল, চাচা, টাকাটা রাখুন।
আশরাফ বললেন, বাবা, টাকাটা আমি রাখতাম, কিন্তু বড় একটা সমস্যা হয়েছে। আমার মেয়ে আমার কাছে স্বীকার করেছে, এই জাতীয় কোনো ঘটনা ঘটে নাই। হিশাম সাহেবের আদেশে সে কাজটা করেছে। নিজেই দৌড় দিয়ে আলাউদ্দিন সাহেবের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে চিৎকার শুরু করেছে। দরজা ভেঙে তাকে সবাই বের করেছে। সে অজ্ঞান হবার ভান করেছে। বাবা, অত্যন্ত লজ্জার একটা ঘটনা। আমার মেয়েকে আল্লাহপাক এই কারণে কঠিন শাস্তি দিবেন। নবিজীর শেফায়াত সে পাবে এরকম মনে হয় না।
মুহিব আগ্রহ নিয়ে বলল, তাহলে তো চাচা, ঘটনা অনেক সহজ হয়ে গেল। আপনার মেয়ে কোর্টে গিয়ে আসলে কী ঘটেছে সেটা বলবে। আমার বাবা ছাড়া পাবেন।
আশরাফ চুকচুক করে তার সামনে রাখা চিরতার পানি সবটা খেলেন। মুখে লেবুর টুকরা দিয়ে থেমে থেমে বললেন, এই কাজটা আমার মেয়ে করবে না। মেয়েটা নষ্ট হয়ে গেছে। হিশাম মেয়েটাকে নষ্ট করেছে। হিশাম বিপত্নীক মানুষ। সালমাকে বিয়ে করবে— এইরকম লোভ দেখাচ্ছে। সালমা এখন তার সঙ্গেই থাকে। কিয়ামতের আগে আগে এই ধরনের পাপাচার হয়। কেয়ামত নজদিক।
মুহিব বলল, ঘটনা কী ঘটেছে আপনি যদি কোর্টে গিয়ে বলেন তাহলেও মনে হয় হবে।
আশরাফ বললেন, আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। আমি হিশামের আশ্রয়ে বাস করি। তবে আমি খাস দিলে তোমার পিতার জন্য দোয়া করব। বিচারকের দিলে যেন রহম হয়, তার জন্যে রোজা খব। এবং কোরান খতম দিব। বাবা, তোমাকে কি এক গ্লাস চিরতার পানি দিতে বলব? শরীরের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। সারাদিনের নানান কর্মকাণ্ডে শরীরে যে বিষ উৎপন্ন হয়, সব নষ্ট করে দেয়।
মুহিব উঠে পড়ল। এর সঙ্গে কথা বলার আর কিছু নাই।
মুহিব গেল হামিদুজ্জামানের কাছে। হামিদুজ্জামান বললেন, ঘুরে ফিরে সেই আমার কাছে?
মুহিব বলল, জি চাচা।
টাকা এনেছ? না-কি empty handed?
টাকা এনেছি। এখানে সাড়ে চার লাখ আছে।
চার চেয়েছিলাম, সাড়ে চার এনেছ কেন?
মুহিব কিছু বলল না। হামিদুজ্জামান মানিব্যাগ খুলে তার মেয়ের ছবি বের করলেন। ছবি এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, মেয়ে দেখতে কেমন বলো।
জি সুন্দর।
সুন্দর কিছু দেখলে বলতে হয় মাশাল্লাহ। বলো মাশাল্লাহ।
মুহিব বলল, মাশাল্লাহ।
মেয়ের ডাকনাম মায়া। তোমার নামের সঙ্গে মিল আছে। তুমি মুহিব, সে মায়া। স্বামী-স্ত্রীর নামের মিল থাকলে সংসার সুখের হয়। মায়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চাও?