নিলি বলল, খাওয়া দেয়া হয়েছে। খেতে আসুন। আর যদি আপনার আপত্তি না থাকে, আপনার বাবা কী সমস্যায় পড়েছেন সেটা বলুন।
মুহিব বলল, আমার বাবা একটা মেয়েকে রেপ করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন। এখন হাজতে আছেন।
এই নিউজটাই কি পত্রিকায় এসেছে?
জি। ম্যাডাম, আমি কিছু খাব না। আমার মা এবং বোন সারাদিন আমার জন্যে অপেক্ষা করেছে। তাদের সঙ্গে দেখা হয় নি। তারা নিশ্চয়ই না খেয়ে আছে। ম্যাডাম, যাই! আপনার ছেলেটাকে দেখে এত ভালো লেগেছিল। কী মিষ্টি যে তার কথা! বলে কী— গোলাপ ফুল আমাকে গোঁতা দিয়েছে।
মুহিব বাসায় ফিরল না। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে থাকল। প্রথম উপস্থিত হলো আলাউদ্দিন কোচিং সেন্টারে। সাইনবোর্ড এখনো আছে। সাইনবোর্ড নামানো হয় নি। কাল-পরশুর মধ্যে নিশ্চয়ই নামিয়ে ফেলবে। কোচিং সেন্টারের চারদিকে তিনবার চক্কর দিল। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে গেল লীলাদের বাড়িতে। পুরো বাড়ি অন্ধকার, শুধু লীলার ঘরে বাতি জ্বলছে। অর্থাৎ লীলা জেগে আছে। মুহিব ঠিক করল, লীলার ঘরের বাতি না নেভা পর্যন্ত সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে। বাতির দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিছু না, একটা খেলা। অতিরিক্ত দুঃশ্চিন্তার সময় ছেলেমানুষী খেলা খেলতে ভালো লাগে।
মুহিব বাসায় ফিরল রাত তিনটায়। তার মা এবং অশ্রু দুজনই না খেয়ে অপেক্ষা করছে। ভয়ে এবং দুঃশ্চিন্তায় দুজনই অস্থির।
রাজিয়া বেগম বললেন, কোথায় ছিলিরে বাবা?
মুহিব বলল, রাস্তায় হাঁটছিলাম। গরম পানির ব্যবস্থা কর তো মা, গোসল করব। তোমরা খাওয়াদাওয়া করেছ?
না।
ঘরে রান্না কী?
রান্না হয় নাই। ডিম ভাজি করে দেই?
দাও।
তোর বাবার অবস্থা কী?
মুহিব বলল, বাবার আলাপ এখন থাকুক। বাবা ভালো আছেন। সিগারেট খাওয়া ধরেছেন। একজন হাজতি পাওয়া গেছে যে সিগারেটের বিনিময়ে বাবার পা টিপে দিচ্ছে।
রাজিয়া বললেন, আমাকে নিয়ে যাবি? দেখা করতাম।
দেখা করে কী বলবে?
রাজিয়া জবাব দিলেন না। গরম পানির ব্যবস্থা করতে গেলেন। অশ্রু ভাইয়ের পাশে বসে রইল।
মুহিব বলল, তোর ভূতটার খবর কী? এখনো খাটের নিচে বসে থাকে?
অশ্রু বলল, বাবার ঐ ঝামেলার পর ভূতটাকে দেখছি না।
মুহিব বলল, বাবার ঘটনায় তুই বিশাল এক ধাক্কার মতো খেয়েছিস। সেই ধাক্কা ভূত বাবাজির গায়েও লেগেছে, ভূত পালিয়েছে। আমার মনে হয় না তুই এই ভূত আর দেখবি। সব মন্দের একটা ভালো দিক আছে।
অশ্রু বলল, ভাইয়া, তোমার গা থেকে বিকট সিগারেটের গন্ধ আসছে।
মুহিব বলল, একটার পর একটা সন্তী সিগারেট খেয়ে যাচ্ছি। গন্ধ তো আসবেই। এখন একটা ধরাব। পানি গরম না হওয়া পর্যন্ত সিগারেট ব্রেক।
মুহিব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, শূন্যে ভাসা খেলা দেখবি?
শূন্যে ভাসা খেলা কী?
মুহিব বলল, আমি তোর চোখের সামনে শূন্যে ভেসে থাকব।
অশ্রু বলল, ভাইয়া, আমার মনে হয় তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
মুহিব বলল, সম্ভাবনা আছে। ইচ্ছা করছে সারাক্ষণ শুন্যে ভেসে থাকি।
আবার পত্রিকার প্রথম পাতায়
আলাউদ্দিন আবার পত্রিকার প্রথম পাতায় চলে এসেছেন। পুলিশ তাকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল। রিমান্ডে তিনি সব স্বীকার করেছেন। পত্রিকার খবরের শিরোনাম–
ধর্ষক শিক্ষকের অপরাধ স্বীকার
ঘটনার রগরগে বর্ণনা
খবরের কাগজের প্রতিবেদক লিখছেন— ধর্ষক আলাউদ্দিন ছাত্রীকে নিজের খাসকামরায় ডেকে আনেন। ছাত্রীর লেখা রচনায় ইংরেজি বানানের ভুলগুলি ধরিয়ে দেবার জন্যে। এক পর্যায়ে তাকে বলেন— বাইরে হৈচৈ হচ্ছে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসো। সরল মনে ছাত্রী তাই করে। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি উঠে পড়েন এবং বলেন— দরজা পুরোপুরি না বন্ধ করলে শব্দ যাবে না। এই বলে নিজেই দরজার ছিটিকিনি লাগিয়ে দেন এবং ছাত্রীর সামনে এসে বসতে বসতে বলেন, তোমাকে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে বিবাহ করা সম্ভব না। ঘরে আমার বড় বড় ছেলেমেয়ে আছে। এখন তোমার কাছে বৃদ্ধের একটা আবদার…
এই পর্যন্ত পড়ে মুহিব কাগজ ভাঁজ করে একপাশে রাখল। সে বসেছে আমানুল্লাহ টি স্টলে। নিলি ম্যামের বাড়ির কাছে টি স্টল। প্রায়ই সে এখানে চা খেতে আসে। তার সঙ্গে বড় লাল রঙের ফ্লাস্ক। আজ সারাদিনে তার অনেক কর্মকাণ্ড আছে। একেকটা কাজ শেষ করবে আর এক কাপ করে চা খাবে। প্রথম যাবে আলাউদ্দিন কোচিং সেন্টারে। কোচিং সেন্টারের বর্তমান প্রধান আবু হিশাম তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। জরুরি কী কথা না-কি আছে।
মুহিবের পাশে বসা কাস্টমার বলল, ব্রাদার, কাগজটা কি পড়া হয়েছে?
হ্যাঁ।
ইন্টারেস্টিং কিছু আছে?
ধর্ষণ নিউজ আছে। পড়লে মজা পেতে পারেন। মুহিব কাগজ এগিয়ে দিল। তার দুকাপ চা খাওয়া হয়ে গেছে। এখন উঠে যাবার সময় হয়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। আবার বসে থাকতেও ভালো লাগছে না। গত পাঁচদিন তার বাবার সঙ্গে মুহিবের দেখা হয় নি। ওসি সাহেব বলেছেন আজ দেখা করা যাবে। আজকের পর দেখা করা সমস্যা হবে। তাকে থানা-হাজত থেকে জেল-হাজতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
মুহিব আরেক কাপ চায়ের অর্ডার দিল। তার পাশে বসা লোক গভীর আগ্রহে আলাউদ্দিনের স্বীকারোক্তি পড়ছে। মুহিব তাকিয়ে আছে লোকটির দিকে এবং চিন্তা করছে বাবাকে নিয়ে তার নিজের আনন্দের কোনো স্মৃতি আছে কি-না। তেমন কিছু মনে পড়ছে না। কোনো না কোনো স্মৃতি নিশ্চয়ই আছে। মাথা Blank হয়ে গেছে। অশ্রুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মেয়েরা সুখের স্মৃতি দুঃখের স্মৃতি সবই মনে করে রাখে। কিছুই ভোলে না।