মুহিব বলল, বিএ সার্টিফিকেটটা খাওয়াচ্ছি। আরাম করে খাচ্ছে বাবা।
আলাউদ্দিন বললেন, বিএ সার্টিফিকেটটা খাওয়াচ্ছিস মানে?
মুহিব বলল, তুমি খাওয়াতে বলেছিলে। ভুলে গেছ?
আলাউদ্দিন ছুটে এসে অর্ধেক সার্টিফিকেট ছাগলের মুখ থেকে উদ্ধার করলেন। তিনি সাটিফিকেট উদ্ধার করেই ক্ষান্ত হলেন না। সেটা বাধাই করে নিজের শোবার ঘরে টাঙিয়ে রাখলেন। যেদিন টাঙালেন সেদিন বাসার সবাইকে ডেকে এনে বললেন— অর্ধেক সার্টিফিকেট টাঙিয়ে রেখেছি কী জন্যে জানো? সবাইকে একটা জিনিস বোঝানোর জন্যে। সেটা হচ্ছে, সার্টিফিকেটের মতো আমার পুত্রও অর্ধমানব।
এখন মুহিবদের পরিবার সম্পর্কে বলা যাক। মুহিবের বাবা আলাউদ্দিন একটা গার্লস স্কুলের হেডমাস্টার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এখন নিজেই মেয়েদের একটা কোচিং সেন্টার চালান। নাম আলাউদ্দিন কোচিং। কোচিং সেন্টারের মেয়েরা তাকে ডাকে বক্ষ-স্যার। কারণ তিনি নাকি মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে পড়ান না। বুকের দিকে তাকিয়ে পড়ান। তার কোচিং সেন্টারের যথেষ্ট সুনাম আছে। তিনি নিজেও ইংরেজি খুব ভালো পড়ান।
অবসর সময়ে আলাউদ্দিন গান লেখেন। বেতার এবং টিভির তিনি একজন এনলিস্টেড গীতিকার। বাজারে তার দুটি বইও আছে— ঈশ্বর ও ধর্ম এবং কোরানের আলোকে বিজ্ঞান। কোচিং সেন্টারের ছাত্রীদের বই দুটি কেনা বাধ্যতামূলক।
আলাউদ্দিনের প্রথমপক্ষের স্ত্রীর গর্ভের সন্তান তিনজন। বড় দুই মেয়ের পর মুহিব। বড় দুই মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাবার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। প্রথমপক্ষের স্ত্রীর নাম শেফালী। তিনি কিঞ্চিৎ অপ্রকৃতস্থ। ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন।
দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী রাজিয়া বেগমের একটি সন্তান, নাম অশ্রুমালা। ডাকা হয় অশ্রু। অশ্রু বাবার কোচিং সেন্টারে পড়াশোনা করছে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। কোচিং সেন্টারে অশ্রুর নাম হয়েছে কাউয়া। যদিও তার গায়ের রং শাদা। যথেষ্ট রূপবতী। বড় বড় চোখ। কাটা কাটা নাকমুখ।
অশ্রুর চরিত্রের বিশেষত্ব হচ্ছে, সে প্রায়ই সন্ধ্যার পর বাড়িতে ভূত দেখে। ভয় পেয়ে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে যায়। একটা ভূতকেই সে দেখে। পুরুষ ভূত। নগ্ন থাকে। সে বিশেষ উদ্দেশ্যে অশ্রুকে জড়িয়ে ধরতে চায়।
বুধবার সকাল দশটা। মুহিব লীলাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
লীলাদের বাড়ির কলিংবেল তিনমাস ধরে নষ্ট। চাপ দিলেই ইলেকট্রিক শক খেতে হয়। লীলা কলিংবেলের ওপর লালকালি দিয়ে একটা নোটিশ টাঙিয়েছে।
সাবধান
কলিংবেল নষ্ট। চাপ দিলেই শক খাবেন।
দয়া করে কড়া নাড়ুন।
কলিংবেল সারানো কোনো ব্যাপার না। মোড়ের ফ্যানের দোকানের একজন মিস্ত্রি ধরে নিয়ে এলেই সে কাজটা করে দেবে। লীলার বাবার কারণে কাজটা করা হচ্ছে না। বাড়ির যাবতীয় কাজকর্মে তার নিজের পরিকল্পনা থাকে। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, কলিংবেল সাৱননা কোনো বিষয় না। এর জন্যে মিস্ত্রিকে একশ টাকা দেবার কোনো মানে হয় না। কাজটা তিনি নিজেই করবেন। তিনি আজিজ মার্কেট থেকে একটা বই কিনে এনেছেন। বইয়ের নাম ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি সারাই। গত তিনমাস ধরে তিনি মন দিয়ে বইটা পড়ছেন। তার বাড়িতে কারেন্ট Two phase না-কি One phase এই নিয়ে তিনি সামান্য বিভ্রান্ত। পুরো বইটা তার একবার পড়া হয়েছে। এখন তিনি দ্বিতীয়বার পড়ছেন।
লীলার বাবার নাম শওকত চৌধুরী। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হিসাবে রিটায়ার করেছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা মামলার গল্প করে বাকি জীবন কাটান। ইনি সেরকম না। বিচারক থাকার সময় তিনি আইনের বই ছাড়া কিছু পড়েন নি। এখন তার বাইরের বই পড়ার অভ্যাস হয়েছে। যে-কোনো বিষয় নিয়ে পড়তে তার ভালো লাগে। তিনি পড়েই ক্ষান্ত হন না, পাঠের বিদ্যা কাঙে লাগানোর চেষ্টা করেন। নীরোগ শরীর, সুস্থ জীবন এবং ঘরে বসে হোমিওপ্যাথ এই দুটি বই পড়ে তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উৎসাহী হয়েছেন। ওষুধপত্র জোগাড় করেছেন। কালো চামড়ার ব্যাগ কিনেছেন। স্টেথিসকোপ কিনেছেন। তিনি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে ওষুধ দেন। মুহিব ছাড়া তেমন কেউ তার কাছে ওষুধ নিতে আসে না। মেয়ের ছেলেবন্ধুকে কোনো বাবাই সহ্য করতে পারেন না। শওকত তার ব্যতিক্রম। তিনি মুহিবকে অত্যন্ত পছন্দ করেন।
কলিংবেলের ওপর লেখা নোটিশটা মুহিব অনেকবার পড়েছে। আজও আবার পড়ল। শুধু যে পড়ল তা-না, হাত দিয়ে ছুঁয়েও দেখল। লীলা নিজের হাতে লাল মার্কার দিয়ে লিখেছে। লেখায় তার স্পর্শ লেগে আছে। লেখাটা লীলা চিন্তা করে লিখেছে। চিন্তাটার জন্য তার মাথার ভেতরের মস্তিষ্কে। কলিংবেলে হাত রাখার অর্থ লীলার মাথার ভেতর হাত রাখা।
মুহিব কলিংবেল চাপল এবং বড় ধরনের শক খেল। সে জানে কলিংবেল চাপা মানেই শক খাওয়া। তারপরেও গত তিন মাসে সে ইচ্ছা করেই অসংখ্যবার শক খেয়েছে। ইচ্ছা করে শক খাওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ আছে। মুহিব কারণটা জানে না।
শওকত দরজা খুললেন এবং আনন্দিত গলায় বললেন, হ্যালো ইয়াং মান। ইউ আর লুকিং গ্রেট।
মুহিব বলল, চাচা, কেমন আছেন?
ভালো আছি। খুবই ভালো আছি। লীলা বাসায় নেই। ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছে।
মুহিব বলল, আমি লীলার কাছে আসি নি চাচা। আপনার কাছে এসেছি। অমাির মায়ের ওষুধ দরকার। বারবার আপনাকে বিরক্ত করি। এত লজ্জা লাগে! আমার মা আবার আপনার ওষুধ ছাড়া অন্য ওষুধ খাবেন না।