জি।
মামলা যে মিথ্যা প্রমাণ দেই। যদিও তোর কাছে প্রমাণ দেয়ার কিছু নাই। তুই তো হাকিম না। প্রমাণ করতে হবে কোটে। যাই হোক শোন, ঘটনা ঘটেছে বেলা বারোটায়। বারোটায় কোচিং-এর ক্লাস হচ্ছে। চারদিকে ছাত্র-ছাত্রী। এর মধ্যে আমি এক মেয়েকে ঘরে ঢুকাব। দরজার ছিটকানি লাগাব। এটা কি সম্ভব? আর ঐ হারামজাদি সালমা দেখছে আমি দরজা বন্ধ করছি, সে কিছুই বলবে না? সে একটা চিৎকার দিলেই তো সব ছুটে আসে। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করতে হয় না। বুঝতে পারছিস?
হুঁ।
মিথ্যা মামলাটা কেন করেছে শোন। কোচিং সেন্টারে আমার শেয়ার ফিফটি, বাকি ফিফটি হিশামের। চলে আমার নামে আলাউদ্দিন কোচিং সেন্টার। সবাই একনামে চিনে। গত বছর থেকে টাকা আসা শুরু হয়েছে। আমাকে আউট করা দরকার। পুরা ঘটনা সাজায়েছে হিশাম। সালমা মেয়েটা তার আত্মীয়। ভাগ্নি না কী যেন হয়।
আমি কি হিশাম চাচার সঙ্গে দেখা করব?
করতে পারিস। যা করবি বিবেচনা করে করবি। গাধার মতো কিছু করবি। মাথা ঠান্ডা রাখবি। যে-কোনো বিপদ থেকে উদ্ধারের একটাই পথ— মাথা ঠান্ডা রাখা। You got to keep your head cool, চেকবইটা দে। এক কাপ চা জোগাড় করা যায় কি না দেখ।
ক্রিমিনাল লইয়ার হামিদুজ্জামানের চেহারা ক্রিমিনালদের মতো। মুখভর্তি খোচা খোচা দাড়ি। ছোট ছোট চুল। মাথা কামানো। যখন কথা বলেন না তখন ঠোট উল্টে রাখেন। তার টেবিলে ছোট্ট আয়না আছে। ঠোট উল্টে আয়নায় নিজেকে দেখেন। চেয়ারের পাশে পিতলের পিকদানি। কিছুক্ষণ পরপর সেখানে থুথু ফেলেন।
মুহিব বলল, স্যার। বাবা বলেছেন, মিথ্যা মামলা।
হামিদুজ্জামান থুথু ফেলে কিছুক্ষণ ঠোট উল্টা করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, বাবারে, সত্য মামলা মিথ্যা মামলা বলে কিছু নাই। মামলা হলো জজ সাহেব। উনি যখন বলবেন মামলা মিথ্যা, তখন সত্য মামলাও মিথ্যা। টাকাপয়সা কী এনেছ?
দশ হাজার টাকা এনেছি।
যেখানে এক সমুদ্র পানি লাগে সেখানে এক চামচ পানি নিয়ে উপস্থিত হয়েছ। মামলার ধরন খারাপ। নন বেলেবল। জামিন হবে না। সেখানে কোর্টে চালান করা মাত্র জামিনে ছাড়ায়ে নিয়ে আসব। আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য দিয়ে তো আনতে পারব না। টাকা দিয়ে ছুটায়ে আনতে হবে। মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষা কি হয়েছে?
জানি না।
ভোমার জানার প্রয়োজনও নাই। যদি মামলা আমি নেই তখন আমিই জানব। ডাক্তারকে টাকা খাওয়ায়ে সার্টিফিকেট বের করব ধর্ষণের আলামত সনাক্ত করা যায় নাই। এই বাবদই শুধু লাগবে পঞ্চাশ হাজার। বুঝেছ?
জি। এত টাকা তো আমাদের নাই চাচা।
হামিদুজ্জান থুথু ফেললেন। ঠোট উল্টে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, তাহলে তো বাবা কিছু করার নাই। তোমার পিতাজিকে কম করে হলেও সাত বছর জেলে থাকতে হবে। তোমাকে পরিষ্কার বলি, ক্রিমিনাল লইয়ার হিসাবে আমার নামডাক আছে। লোকে বলে, ফাঁসির দড়ির ভেতর থেকে আমি আসামি খালাস করে আনতে পারি। কথার মধ্যে কিছু সত্য আছে। তবে লইয়ার আমি ভালো না। আমি টাকা খাওয়ানোতে ভালো। কাকে টাকা খাওয়াতে হবে, কীভাবে টাকা খাওয়াতে হবে, এটা আমি জানি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা নৃত্যনাট্য আছে, নাম মায়ার খেলা। কোর্টের নৃত্যনাট্য হলো— টাকার খেলা। তুমি যাও, তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলে। ব্রুতে মিনিমাম এক লাখ টাকার ব্যবস্থা করতে পারলে আসবে। ব্যবস্থা করতে না পারলে আসবে না। তোমার বাবা আমার পূর্বপরিচিত, এটা ঠিক আছে। পরিচয়ে কিছু হবে না। তোমার বাবাকে কি কোর্টে চালান দিয়েছে? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোর্টে হাজির করার নিয়ম। রিমান্ডের অর্ডার যদি পুলিশ বের করে ফেলে তাহলে সাড়ে সর্বনাশ।
মুহিব বলল, দশ হাজার টাকা নিয়ে এসেছি চাচা, টাকাটা কি রাখবেন?
হামিদুজ্জামান থুথু ফেলতে ফেলতে বললেন, না।
মুহিব উঠে দাড়াল। এখন সে যাবে আলাউদ্দিনের কোচিং বিজনেসের পার্টনার হিশাম সাহেবের কাছে। মুহিব তাকে ভালো করেই চেনে। অনেকবার তাদের বাড়িতে এসেছেন। শান্ত-ভদ্র চেহারা। হজ্জ করে আসার পর দাড়ি রেখেছেন। চোখে সুরমা দেন। গলার স্বর মিষ্টি।
হিশাম সাহেব কোচিং সেন্টারেই ছিলেন। মুহিকে দেখে বললেন, তুমি আসবে জানতাম। কী ঘটনা ঘটে গেছে দেখেছ? কেউ কি আর এই কোচিং সেন্টারে ভর্তি হবে? ছিঃ ছিঃ, কী কেলেংকারি! সালমা মেয়েটা আমার আপন ভাগ্নি। তার সামনে মুখ দেখাতে পারি না। আমি তাকে বললাম, দরজা ভেঙে তোকে বের করতে হলো কেন? আগে চিৎকার দিলি না কেন? গাধি মেয়ে বলে, লজ্জায়। এখন লজ্জা কই গেল! দুনিয়ার পত্রিকার তোক বাড়িতে আসছে। এক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক এসেছে ক্রাইম রিপোর্টিং করবে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।
মুহিব বলল, চাচা, আমি কি সালমা মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
কী কথা বলবে?
মুহিব চুপ করে রইল। হিশাম বললেন, তোমার তো কথা বলার কিছু নাই। তোমার বাপ এত বড় একটা ঘটনা ঘটায়েছে— তুমি ছেলে হয়ে তার সামনে যাকে কীভাবে?
মুহিব বলল, তাও ঠিক।
হিশাম বললেন, জানাজানি বেশি হয়ে গেছে। জানাজানি কম হলে ঘটনা ধামাচাপার ব্যবস্থা করতাম। এখন সেই পথও নাই।
চাচা, মেয়েটার সঙ্গে কি আমি টেলিফোনে কথা বলতে পারি?
তুমি কথা বলার জন্য কেন অস্থির হয়েছ বুঝলাম না। তোমার কথা বলার তো কিছু নাই।
মুহিব বলল, বাবার হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম। পায়ে ধরে পড়ে থাকতাম।