ভদ্রলোক ইশারা করে কাকে যেন ডাকলেন। তাকে বললেন, জলিল, উনার কাছ থেকে গিফট নিয়ে যাও।
মুহিব বলল, নিলি ম্যাডাম বলে দিয়েছেন আমি যেন নিজের হাতে তাকে গিফটটা দেই।
ভদ্রলোক বললেন, জলিল, উনাকে পদ্মর কাছে নিয়ে যাও। আর ভাই, আপনি গিফট দিয়ে ছাদে চলে আসবেন। পার্টি এনজয় করবেন। আপনার নাম?
মুহিব।
মুহিব সাহেব, পরে আপনার সঙ্গে দেখা হবে।
ঘরভর্তি উপহারের মাঝখানে একটা দুবছরের বাচ্চা লাল শার্ট লাল প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে উপহার দেখছে। কোনো একটা বাক্সে হাত দেয়া মাত্র বৃদ্ধা এক মহিলা ধমক দিচ্ছে, হাত দিবা না কইলাম।
মুহিবের মনে হলো এই মহিলাই সজিরন। পদ্মর আয়া।
মুহিব বলল, পদ্ম! কাছে আস, তোমার মা তোমার জন্যে কী পাঠিয়েছেন দেখ।
পদ্ম পরিষ্কার গলায় বলল, আমার মা পাঠিয়েছে?
মুহিব বলল, হ্যাঁ।
নিলি মা পাঠিয়েছে?
হ্যাঁ।
বলেছে—বাবুকে আদর?
হ্যাঁ বলেছেন। এসো আমরা উপহার খুলি।
পদ্ম ছুটে এল। বৃদ্ধা খ্যাখ্যান গলায় বলল, বাক্স এখন খোলা স্যারের নিষেধ আছে। পরে খোলা হবে। একপাশে থুইয়া দেন। সময় বুইঝা খোলা হইব।
মুহিব বলল, তোমার নাম সজিরন না?
জে।
মুহিব বলল, বাঘের ওপরে আছে টাগ। তোমার স্যারের ওপরে আছে নিলি ম্যাডাম। তুমি মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, এই খবর আমরা জানি। হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে। যদি প্রমাণ হয় তুমি মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছ, তোমার চার বছরের জেল হবে। জেলে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে যাও। পান খাওয়ার অভ্যাস আছে দেখতে পাচ্ছি। অভ্যাস ছাড়ার চেষ্টা কর। জেলে পান পাবে না। সমস্যা হবে।
মুহিব প্যাকেট খুলছে। পদ্ম ছোট ছোট হাতে তাকে সাহায্য করছে। এবং টুক টুক করে কথা বলছে।
গোলাপ ফুল আমাকে গোঁতা দিয়েছে।
মুহিব বলল, কাটা লেগেছে হাতে?
হুঁ। এইখানে।
পদ্ম হাত বাড়িয়ে বলল, উম্মা দাও।
উম্মা ব্যাপারটা কী মুহিব বুঝতে পারছে না।
সজিরন বলল, হাতে চুমা দিতে বলতাছে।
মুহিব সজিরনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই বেটি খবরদার, আমার সাথে কথা বলবি না। বদের হাডিড। ইয়া নফসি ইয়া নফসি করতে থাক। তোর কপালে দুঃখ আছে।
সজিরন বলল, আমি স্যারের বগলে যাইতেছি। আপনি কী বলছেন সব বুলব।
মুহিব বলল, যা তাড়াতাড়ি যা।
সজিরন ঘর থেকে বের হওয়া মাত্র মুহিব পদ্মকে গাড়িতে বসিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এখানে বেশিক্ষণ থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
মুহিব বাড়িতে ফিরল রাত নটায়। বাড়িতে ঢুকতে পারল না।
বাড়ির সামনে ভিড়। লোকজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। পুলিশের একটা জিপ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাড়ি ঘিরেও ভিড়। মুহিবের চোখের সামনে তার বাবা আলাউদ্দিনকে পুলিশের গাড়িতে তুলল। আলাউদ্দিনের হাতে হাতকড়া। কোমরে দড়ি। তিনি বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পড়লেন। মুহিব পুলিশের গাড়ির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করছে। ভিড় ঠেলে কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। সে বাবা বলে চিৎকার দিতে যাচ্ছে, তার আগেই গাড়ি ছেড়ে দিল।
তিনটা খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায়
তিনটা খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় আলাউদ্দিনের ছবি ছাপা হয়েছে। তাদের সংবাদ শিরোনাম–
প্রধান শিক্ষক কর্তৃক
ছাত্রী ধর্ষিত।
কোচিং সেন্টারে প্রধান শিক্ষক
কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণের চেষ্টা।
শিক্ষক হাজিতে।
কন্যাসম ছাত্রী
শিক্ষকের যৌন লালসার শিকার।
ধর্ষণের চেষ্টাকালে শিক্ষক ধৃত।
মুহিব হাজতে তার বাবার সামনে বসে আছে। সে তার বাবার দিকে তাকাতে পারছে না। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আলাউদ্দিন সিগারেট খান না। তার হাতে সিগারেট। ভুস ভুস করে ধোয়া ছাড়ছেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। চুল উসকোখুসকো। একটা চোখের নিচে গাঢ় হয়ে কালি পড়েছে।
মুহিব বলল, মারধোর করেছে না-কি বাবা?
আলাউদ্দিন বললেন, হুঁ। ওসি সাহেবকে টাকা খাওয়াতে হবে। টাকা খাওয়ালে মারধোর হবে না। চেকবই আনতে বলেছিলাম, এনেছিস?
হুঁ।
ব্যাংকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা আছে। চেক লিখে দেই। পুরাটাই তুলবি। ওসি সাহেবকে দিবি দশ হাজার। হাতেপায়ে ধরে বলবি, এর বেশি দেওয়ার সামর্থ্য নাই। পায়ে ধরতে পারবি না?
পারব।
অশ্রুকে সাথে নিয়ে আসিস। সেও যেন ওসি সাহেবের পায়ে ধরে। এক লাখ বিশ থেকে দশ চলে গেল। বাকি থাকল এক লাখ দশ। দশ দিবি উকিলকে। হমিদুজ্জামান নামে আমার পরিচিত এক ক্রিমিনাল লইয়ার আছে। ঘাগু লোক। ঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি, তার সঙ্গে দেখা করবি।
আচ্ছা।
এক লাখ টাকা নিয়ে ঐ মেয়েটার সঙ্গে দেখা করবি। তোর মাকে সাথে নিয়ে যাবি। মামলা যাতে তুলে নেয় সেই ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখবি। টাকা আগেই দিবি না। যদি বলে মামলা তুলে নিবে তখন দিবি। মনে হয় তুলবে না।
মেয়েটার নাম কী?
সালমা। বাবার নাম আশরাফ। তার ঠিকানা জানি না। মিরপুরে কিসের যেন দোকান আছে। খুঁজে বের করবি। কোচিং সেন্টারের রেজিষ্টারে ঠিকানা আছে। বের করতে পারবি না?
পারব।
আলাউদ্দিন হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে আরেকটা ধরলেন। কিছুক্ষণ কাশলেন, তারপর লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, তুই অন্যদিকে তাকিয়ে আছিস কী জন্যে? কোনোরকম ঘটনা ঘটে নাই। মিথ্যা মামলা।
মিথ্যা মামলা?
অবশ্যই। যে-কোনো গাধা বুঝবে মিথ্যা মামলা। তোর বৃদ্ধি গাধারও নিচে বলে ভেবেছিস সত্যি। বাবার দিকে তাকাচ্ছিস না। অথচ আমি তোর জন্মদাতা পিতা। এক হাদিসে আছে— রসুলুল্লাহ সাল্লালাহে আলায়হেস সালাম বলেছেন, আমি যদি আল্লাহপাক ব্যতীত অন্যকাউকে সেজদা দেয়ার হুকুম দিতাম সে হতে জন্মদাতা পিতা। বুঝেছিস?