মুহিব বলল, সজিরন কি এখন বাড়িতে পল্লীর দেখাশোনা করে?
ঠিকই ধরেছেন। আপনার বুদ্ধি ভালো। আপনি অভিনয় ভালো করবেন। বেকুবরা অভিনয় করতে পারে না। চা খাবেন?
মুহিব বলল, না। আমি চা খেয়ে এসেছি। রাস্তার মোড়ে একটা চায়ের দোকান আছে, ভালো চা বানায়। সেখান থেকে পরপর তিনকপি চা খেয়েছি। চা এরকম যে এক কাপ খেলে আরেক কাপ খেতে ইচ্ছা হয়।
নিলি বলল, আফিং টাফিং নিশ্চয় মেশায়া চা এমন কোনো নেশার জিনিস যে পরপর তিন কাপ খেতে ইচ্ছা করবে। একদিন খেয়ে দেখতে হবে।
মুহিব বলল একটা ফ্লাস্ক দিন। ফ্লাস্কে করে নিয়ে আসি।
নিলি বলল, চা আনতে হবে না। আচ্ছা শুনুন, সন্ধ্যাবেলা একটা কাজকরে দিতে পারবেন?
মুহিব বলল, পারব।
নিলি বলল, কী কাজ না জেনেই বললেন পারব?
মুহিব বলল আমার ধারণী পদ্মার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাকে আপনি উপহার। পাঠাবেন। সেই উপহার নিয়ে যেতে হবে আমাকে।
নিলি বলল, ঠিক ধরেছেন। ফ্লাস্ক দিচ্ছি। চা নিয়ে আসুন।
চুহিব বলল, গিফট কি কেনা হয়েছে?
নিলি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। বড় একটা গাড়ি কিনেছি। ব্যাটারি অপারেটেড প্যাডেলে চাপ দিলেই গাড়ি চলবে। পদ্মর বয়স দুবছর–প্যাডেলে চাপ দেয়ার বিষয়টা সে বুঝতে পারবে কিনা জানি না। আমার ধারণা বুঝবে। ওর অনেক বুদ্ধি। ওর বুদ্ধির একটা গল্প শুনবেন?
গুনব।
নিলি বলল, না থাক।
নিলির চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখ মুছছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মুহিবের চোখে পানি এসে গেছে। সে অন্যদিকে ঘুরে তাকিয়ে আছে। সে চাচ্ছে চোখের পানি যেন চোখেই শুকিয়ে যায়। সে চোখের পাতা ফেলছে না।
মুহিব!
জি ম্যাডাম। You are a good soul, আমি যে নাটকটা করব না বলেছিলাম সেটা করব। আপনার জীবনের প্রথম অভিনয় নষ্ট হতে দেব না।
ম্যাডাম, অভিনয় নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। হলে হবে। না হলে হবে না।
নিলি হাসতে হাসতে বলল, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি হিমু হবার চেষ্টা করছেন। আপনার কি রূপা বলে কেউ আছে?
মুহিব বলল, আছে। তার নাম লীলা।
বাহ কী সুন্দর নাম!
লীলার একটা পোষা বদর আছে। বাঁদরটার নাম সুন্দর–হড়হড়কু।
সুন্দর কোথায়? অদ্ভুত নাম। এই নাম কেন?
লীলার ধারণা এই নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখ খানিকটা বাঁদরের মতো হয়। ওর দুটা পোষা ময়ুর আছে। একটার নাম চিত্রা আরেকটার নাম মিত্রা।
নিলা বলল, আপনার বান্ধবীকে দেখার ইচ্ছা করছে। আপনাদের প্রথম দেখা কীভাবে হয়?
নর্দমাতে দেখা। লীলা এই নিয়ে চারলাইনের একটা ইংরেজি কবিতাও লিখেছে, শোনাব?
অবশ্যই শোনাবেন।
মুহিব বলল,
We were in the drain
I looked at him and saw his pain
with weariness and fault
I cave the dirty stain.
লীলার জ্বর নেই তবে চেহারায় জুরের ছায়া পড়ে আছে। তাকে ক্লান্ত এবং বিষণ্ণ লাগছে। তার ইচ্ছা করছে বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকতে। লবণ-বাতির রহস্য আলো ছাড়া ঘরে আর কোনো আলো থাকবে না। লবণ-বাতি লীলার ছোট মামা স্পেন থেকে পাঠিয়েছেন। খনিজ লবণের একটা টুকরার ভেতর বাল্ব জ্বলে। বাল্বের আলো লবণের দেয়াল ভেদ করে আসার সময় অদ্ভুত লাল হয়ে যায়। লীলা এই লালের নাম দিয়েছে লবণ-লাল। এই লাল রঙ নিয়ে সে অনেকদিন থেকে একটা কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্রথম লাইনটা মাথায় এসেছে— When the salt red glows in the dark radiating sorrow…। দ্বিতীয় লাইন আসছে না।
লীলা বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। তার সামনে আদার রস দেয়া এক কাপ গ্রিন টি। সে মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। তার সামনে আহসান বসে আছে। তার গায়ে হালকা মেরুন রঙের পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির রঙের সঙ্গে লবণ-আলোর মিল আছে। দ্রলোককে সুন্দর লাগছে। আহসান নিচু গলায় কথা বলে যাচ্ছে। লীলা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে তার প্রতিটি কথা সে মন দিয়ে শুনছে। আসলে তা-না। লীলার মাথায় লবণ-আলো কবিতার দ্বিতীয় লাইন ঘুরছে। দুটা মাত্র শব্দ মাথায় এসেছে Radiating sorrow…। আর আসছে না।
আহসান বলল, লীলা, তুমি কি ডেভিড ব্রেইনের নাম শুনেছ?
লীলা বলল, না। উনি কি কবি?
আহসান বলল, ম্যাজিকের কবি। street magician, অসাধারণ সব ম্যাজিক দেখান।
তার কথী এল কেন?
আমি নিউইয়র্কে তার একটা ম্যাজিক দেখেছি। Levitation Magic.
লেভিটেশন ম্যাজিক মানে?
লেভিটেশন মানে শূন্যে ভাসা। উনি নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় সবার সামনে শূন্যে ভেসেছেন। রাস্তা থেকে ছয় ইঞ্চি ওপরে উঠে দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড ছিলেন।
লীলা বলল, দুই মিনিট শূন্যে ভেসে লাভ কী?
মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে দুই মিনিটের জন্যে অগ্রাহ্য করে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের চমকে দিয়েছেন, এইটাই লাভ। লীলা, তুমি মনে হয় মন দিয়ে আমার কথা শুনছ
। আবার জ্বর আসছে না-কি? দেখি হাতটা বাড়াও তো, জ্বর দেখি।
লীলা হাত বাড়াল। আহসান লীলার হাত ধরল। লীলা মনে মনে গুনছে one thousand one, ore thousand two one thousand three…
আহসান কতটা সময় হাত ধরে থাকে সেটা জানার জন্যেই one thousand one, two… বলা। একবার one thousand one বলতে এক সেকেন্ড লাগে।
লীলার হিসেবে এগারো সেকেন্ড পর আহসান হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, মনে হচ্ছে জ্বর আসছে।
লীলা বলল, আসুক। ঝড় আসছে আসুক।
ঝড় বলছ কেন?
লীলা বলল, জ্বর হলো শরীরের ঝড়। এই কারণেই ঝড় বলছি। ম্যাজিক সম্বন্ধে কী বলছিলেন বলুন। ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক দুই মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড শূন্যে ঝুলে রইলেন।