লীলা টেলিফোন রেখে দিল।
রাতে বৃষ্টিতে ভিজে
রাতে বৃষ্টিতে ভিজে লীলার ভালো ঝামেলা হয়েছে। শেষরাতে জ্বর এসেছে। শুরু হয়েছে ভাঙা ভাঙা স্বপ্ন। একটা শেষ হওয়া মাত্র আরেকটা। মাঝে মাঝে পানির পিপাসায় ঘুম ভাঙছে। খাটের পাশের সাইড টেবিলে পানির বোতল থাকে। বোতলে পানি নেই। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল আনার প্রশ্নই আসে না। যতবার ঘুম ভেঙেছে ততবারই লীলা ক্লান্ত গলায় বলছে, কেউ কি আমাকে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাওয়াবে? বলার জন্যে বলা। ঘরে সে এবং তার বাবা ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণী নেই। শওকত সাহেবের ঘর সর্বক্ষিণে। তিনি দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমান। চিল্কার করে ডাকলেও তার কানে যাবে না। কে তার জন্যে পানি নিয়ে আসবে? তবে জাগ্রত অবস্থায় পানি চাওয়ার একটা সুফল পাওয়া যাচ্ছে। স্বপ্নে তার জন্যে পানি আসছে। প্রতিবারই সাত-আট বছরের একটি বালক পানি নিয়ে আসছে। বিশাল সাইজের গ্লাসভর্তি পানি। সে পানি এনে বলছে, মা, পানি এনেছি। লীলা হাতে পানির গ্লাস নিচ্ছে, কিন্তু গ্লাসে মুখ দেবার আগেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। স্বপ্নের বাচ্চাটা তাকে মা ডাকছে কেন কে জানে? তার অবচেতন মন কি চাইছে তার বিয়ে হোক? একটা বাচ্চা হোক। বাচ্চা তাকে মা ডাকুক?
সকাল আটটা। লীলা চাদরের নিচে। সে বুঝতে পারছে না। তার কি ঘুম ভেঙেছে, না-কি স্বপ্ন দেখছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ কানে আসছে। কে চালাবে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার? কাজেই এটা স্বপ্ন। রান্নাঘর থেকে কল ছাড়ার শব্দ আসছে। কেউ থালাবাসন ধুচ্ছে। অবশ্যই স্বপ্ন। লীলা চেষ্টা করল জেগে ওঠার। আর তখন তার ঘরের দরজা কেউ একজন সামান্য ফাক করে বলল, আপা, গুড মর্নিং!
বাইশ-তেইশ বছরের মেয়ে। সুশ্রী চেহারা। বড় বড় চোখ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। অ্যাপ্রন পরে আছে। লীলা বলল, কে?
ম্যাডাম, আমার নাম আসমা। আমি আপনাদের হাউসড়ে। আহসান স্যার আমাকে আর গনি মিয়াকে পাঠিয়েছে। আজ এই বাড়িতে উনার পার্টি আছে। আমরা গুছাচ্ছি। ম্যাডাম, চা-কফি কিছু খাবেন?
ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খাব।
ম্যাডাম! আপনার কি শরীর খারাপ?
মনে হয় জ্বর এসেছে।
ম্যাডাম, আমি কি কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখব?
দেখ।
আসমা কপালে হাত দিয়ে বলল, অনেক জুর। ঘরে নিশ্চয় থার্মোমিটার আছে?
বাবার কাছে আছে।
ম্যাডাম, আমি পানি নিয়ে আসছি।
লীলা শুয়ে পড়ল। তার চোখ বন্ধ। জানালা দিয়ে রোদ এসে বিছানায় পড়েছে, সেই রোদের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। চোখ কট কট করছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দটা মাথায় লাগছে। আসমা পানি নিয়ে এসেছে। ট্রে-তে পানির গ্লাস, টিস্যুবক্স, এককাপ চা এবং একটা থার্মোমিটার। লীলা অবাক হয়ে দেখল, আসমা মেয়েটির কাজকর্ম অত্যন্ত গোছানো। সে লীলার হাতে পানির গ্লাস দিল। পানি খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র তার হাতে দুটা টিস্যুপেপার দিল। কী জন্যে দিল লীলা বুঝতে পারল না। চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। পিরিচে দুটা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট।
ম্যাডাম, প্যারাসিটামল খেয়ে চা খান। জ্বর সঙ্গে সঙ্গে কমবে। অনেকেই বলেন, খালি পেটে ওষুধ খাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। অ্যাসপিরিন জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়া যায় না। প্যারাসিটামল খাওয়া যায়। আগে থার্মোমিটারটা মুখে দিন, জ্বর দেখে দেই। টিপেপার দিয়ে থার্মোমিটারের মুখটা মুছে নিন।
হাতে টিস্যুপেপার দেবার রহস্য এখন ভেদ হলো। লীলা মুখে থার্মোমিটার দিয়ে বসে আছে। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দ বন্ধ, এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার। চেয়ার টানাটানির শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের শব্দের মতো অসহনীয় না।
ম্যাডাম! আপনার জ্বর একশ দুই পয়েন্ট পাঁচ। আপনি শুয়ে থাকুন।
লীলা বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ল। আসমা বলল, আহসান স্যার আমাকে বলে দিয়েছেন আপনার ঘুম ভাঙামাত্রই যেন তার সঙ্গে আপনাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেই। ম্যাডাম দেব?
না।
ম্যাডাম, উনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন। এর মধ্যে দুবার টেলিফোন করেছেন। আপনার জ্বর স্যারকে আমি জানিয়েছি। সার খুবই চিন্তিত। স্যারকে ধরে দেই? শুধু হ্যালো বলুন। এতেই হবে।
দাও।
আসমা অ্যাপ্রনের পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করল। নাম্বার টিপল এবং মোবাইল কানে দিয়ে বলল, স্যার, কথা বলুন। সে মোবাইল লীলার হাতে দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল।
লীলা! জ্বর না-কি বাঁধিয়েছ?
হ্যাঁ।
নিশ্চয়ই তোমার অভ্যাস মতো কাল রাতে বৃষ্টিতে ভিজেছ। ঠিক না?
হ্যাঁ ঠিক।
কতক্ষণ ভিজেছ?
ঘড়ি দেখি নি, তবে অনেকক্ষণ ভিজেছি। বৃষ্টিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
আজকের পার্টি অফ করে দেই?
দিন।
আমি কিন্তু আসব। রোগী দেখে যাব।
কখন আসবেন?
রাত আটটায়। তবে আমার ধারণা, তার আগেই তোমার জ্বর সেরে আঁবে। আসমা মেয়েটি তোমাকে সুস্থ করে তুলবে। এই মেয়ে খুব expert.
আসমা মেয়েটি সম্পর্কে বলুন। পার্টি গোছানোর জন্যে পাঠিয়েছেন?
পার্টি গোছানোর জন্যে গনি মিয়াকে পাঠিয়েছি। আর আসমা হলো আমার দিক থেকে তোমাকে উপহার। সংসার ঘড়ির কাটার মতো সচল রাখতে ওর মতো
একটি মেয়েই যথেষ্ট।
তাকে পেয়েছেন কোথায়?
সে দিনাজপুরের মেয়ে। ইন্টারমিডিয়েট পাশ। কুয়েতে এক আমীরের বাড়িতে হাউসমেড় ছিল। নানান ঝামেলায় পড়ে দেশে ফিরে আসে। তার অতীত ইতিহাসের তো তোমার দরকার নেই। না-কি আছে?