কার্ল, তুমি আবারও ভীষণ চমকে দিয়েছে আমাকে। চোরের মত এরকম চুপি চুপি হাঁটো কেন?
ম্যাডাম, আমি খুবই দুঃখিত।
ভবিষ্যতে আর এ-রকম করবে না।
ঠিক আছে, ম্যাডাম।
শোন ইঁদুর-মারা কলগুলো পেতেছে?
ঘরে ইঁদুর নেই।
আবারও সেই এক কথা। কলগুলো পেতেছে কি না বল?
জ্বি, পেতেছি।
বেশ। এখন যাও এখান থেকে।
কফি আনবো আপনার জন্যে?
না, তুমি যাও।
খুব ভোরে ক্রিসের ঘুম ভেঙে গেল। অবাক হয়ে দেখল, রেগান ওর পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মনে হল জেগেই আছে।
কি ব্যাপার, রেগান? এখানে তুমি কি করছো?
মা, আমার বিছানাটা খুব কাঁপছিল … তাই…
বিছানা কাঁপছিল মানে? কি যে তুমি বল?
সত্যি বলছি, মা। বড্ড ভয় করছিল আমার।
ক্রিস মেয়ের কপালে চুমু খেল। চাদরটা গায়ে তুলে দিয়ে গাঢ় স্বরে বলল, ঘুমাও, এখনো ভাল মত ভোর হয়নি।
যাকে মনে হচ্ছিল দিনের সূচনা আসলে তা ছিল এক অন্তহীন রাতের শুরু।
১.২
নিউইয়র্ক সাবওয়ে প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্তে ফাদার ডেমিয়েন কারাস চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। বিকট শব্দ করে ট্রেনগুলো আসছে, যাচ্ছে। তিনি নিশ্চল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন–একটুও নড়ছেন না। অন্ধকার টানেলের ভেতর ছোটছোট ভৌতিক আলো। তাঁর মনে হল, এইসব আলোর যেন নিজস্ব কোন গোপন কথা আছে।
পাশ থেকে বিকট স্বরে কে যেন কাশল। ঘাড় ফিরিয়ে ফাদার দেখলেন, বিকলাঙ্গ একটা লোক উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে। তার চোখ দুটো কেমন হলুদাভ। শার্ট-প্যান্ট বমিতে মাখামাখি। উগ্র গন্ধ আসছে। আহ, কি কুৎসিত! ফাদারের মনে হল, ঈশ্বর বলে কি সত্যি কেউ আছেন? যদি থাকেন তাহলে পৃথিবীতে কি এ ধরনের বীভৎসতা থাকা সম্ভব?
ফাদার, এই পঙ্গু মানুষটিকে দয়া করুন।
লোকটা আবার মুখ ভরে গলগলিয়ে বমি করছে। উঠে দাঁড়াতে পারছে না, বার-বার ঢলে ঢলে পড়ছে।
ফাদার, প্রভু যীশুর দোহাই, দয়া করুন।
ট্রেন আসছে। সটসট শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। ফাদার দেখলেন লোকটা পড়ে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে মাতালের ভরসা হারানো দৃষ্টি।
অজ্ঞান হয়ে গেল নাকি? এপিলেপি? এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে ধরে ফেললেন ফাদার। সাবধানে বসালেন সামনের একটা বেঞ্চিতে। একটা ডলার বের করে গুঁজে দিলেন তার বমি-ভেজা পকেটে।
ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতেই ফাদার নিঃশব্দে ট্রেনে উঠে বসলেন। ফাঁকা ট্রেন। সীটে হেলান দিয়ে দুচোখ বন্ধ করলেন। কোন কোন সময় এইভাবে চোখ বুজে ভাবতে বেশ ভাল লাগে।
ট্রেন থেকে নেমে ফাদারকে ফোর্ডহ্যাম ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত হেঁটে যেতে হল। তিনি গরীব মানুষ, দান করা ডলারটি ছিল তাঁর ট্যাক্সি ভাড়া।
পরদিন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনারে ফাদার ডেমিয়েন স্পিরিচুয়ালিজমের ওপর একটি পেপার পড়লেন। সভা শেষ হওয়ামাত্র মাকে দেখতে ছুটে গেলেন। ম্যানহাটানের একুশ নাম্বার স্ট্রীটে ছোট্ট এক অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর মা একা থাকেন।
ছেলেকে দেখেই মা দৌড়ে এসে কপালে চুমু খেলেন। তারপর বাচ্চামেয়ের মত দ্রুত পায়ে ছুটে গেলেন কফি বানাতে। ফাদার ডেমিয়েনের মনে হল, মাকে ছেড়ে যাওয়া তাঁর কিছুতেই উচিত হয়নি। তিনি অবশ্যি মাকে প্রায়ই চিঠি লেখেন, যদিও সেসব চিঠি তাঁর ইংরেজী না-জানা মা পড়তে পারেন না। না, মাকে ছেড়ে যাওয়া উচিত হয়নি।
বেলা এগারোটার দিকে ফাদার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। যাবার সময় বললেন, খুব শিগগির আবার আসবো, খুব শিগগির।
ওয়েগেল হলে নিজের ঘরে ফিরে তিনি ভাবলেন, মেরিল্যাণ্ড অঙ্গরাজ্যের প্রধান পাত্রীকে একটি লম্বা চিঠি লিখবেন। আগেও লিখেছেন। বক্তব্য একটিই; তাঁকে নিউইয়র্কে বদলি করা হোক। আর বর্তমান দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে শিক্ষকতার কাজে লাগানো থােক। এর কারণ ছিল দুটো। এক, মায়ের কাছে থাকতে পারা। দুই, বর্তমান কাজে তাঁর অক্ষমতা। মায়ের কাছে থাকতে চাওয়ার বিষয়টি সবাই বুঝতে পারে, কিন্তু বর্তমান দায়িত্বে অক্ষমতার বিষয়টি কেউ বুঝতে রাজি নয়। তিনি নিজেও ব্যাখ্যা করতে পারেন না।
কেউ জানে না ফাদার ডেমিয়েনের মনে একটি সন্দেহ দানা বেঁধে আছে। একটি নিষিদ্ধ সন্দেহ। দিন-রাত সর্বক্ষণ তিনি ঈশ্বরের দয়া কামনা করেন। ঈশ্বরকে বুঝতে চান। তবু বুঝতে পারেন না। একটি অশুভ সন্দেহ তাই তাঁকে সব সময় আচ্ছন্ন করে রাখে
ঈশ্বর কি সত্যি আছেন?
হে ঈশ্বর, তুমি নিজেকে প্রকাশ কর আমার কাছে। দূর কর আমার সমস্ত সংশয়। তোমার অস্তিত্বের একটি প্রমাণ তুমি আমাকে দাও! দয়া করো, দয়া করো।
১.৩
১১ এপ্রিল ভোরবেলা ক্রিস ফোন করল তার পুরনো এক ডাক্তার বন্ধুকে। তার একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার। যে রেগানকে দেখবে।
মার্ক, তুমি তেমন কাউকে চেনো?
আগে বল ব্যাপার কি। কি হয়েছে?
ক্রিস পুরো ঘটনাটাই খুলে বলল। রেগানের জন্মদিন গেছে কয়েকদিন আগে। জন্মদিনে সব সময় তার বাবা তাকে ফোন করে, এবার করেনি। এরপর থেকেই রেগান কেমন যেন একটু অন্য রকম। রাতে তেমন ঘুমায় না। স্বভাব হয়েছে ঝগড়াটে। জিনিসপত্র লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলছে। সে আগে খেতে পছন্দ করত, এখন খাওয়া দাওয়া প্রায় বন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা, মনে হয় হঠাৎ যেন ওর শরীরে খুব শক্তি হয়েছে। সারাক্ষণ দৌড়াচ্ছে, লাফাচ্ছে। স্কুলের পড়াশোনাতেও খুব খারাপ করছে। তার ওপর এখন একটা কিছু করে লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ঝোঁক হয়েছে দৃষ্টি আকর্ষণের ব্যাপারটা ঠিক পরিস্কার হল না।