একটা অব্যক্ত ধ্বনি উঠল। কারাসের চোখ থমকে গেল রেগানের মুখের ওপর। এসব কি তিনি সত্যি সত্যি দেখছেন? না চোখের ভুল? তার প্রার্থনায় গণ্ডগোল হয়ে যেতে লাগল। হিস-হিস শব্দ হচ্ছে চারদিকে। ফাদার মেরিন চাপ। স্বরে বললেন, ফাদার ডেমিয়েন কারাস?
জ্বি।
দয়া করে আমার সঙ্গে যোগ দিন। প্রস্তাবনায় অংশ নিন। আমার সঙ্গে সঙ্গে বলুন–শত্রুর ওপর তোমার জয় হোক।
শত্রুর ওপর তোমার জয় হোক।
আমার প্রার্থনা তুমি গ্রহণ কর, প্রভু।
আমার প্রার্থনা তুমি গ্রহণ কর, প্রভু।
নরকের শয়তানের হাত থেকে রক্ষা কর এই শিশুটিকে।
নরকের শয়তানের হাত থেকে রক্ষা কর এই শিশুটিকে।
ফাদার মেরিন রেগানের মুখের ওপর ক্রস এঁকে পবিত্র জল ছিটিয়ে দিলেন। প্রার্থনার প্রথম অংশ শেষ হয়েছে।
ফাদার মেরিন হাত-মুখ পরিষ্কার করবার জন্যে ঘর থেকে বেরোতেই রেগানের মুখ থেকে খিকখিক হাসির আওয়াজ হল। সে হাসি থামতেই কেউ একজন ফিস ফিস করে বলল, মেরিন হারতে শুরু করেছে। হারতে শুরু করেছে। এই কুত্তী মাগীর মরবার সময় এসে গেছে। দেখ, কারাস দেখ। তুই তো আবার ডাক্তার, ওর নাড়ি পরীক্ষা করে দেখ।
কারাস দেখলেন নাড়ির গতি অত্যন্ত ক্ষীণ।
দেখলি? এই শুরু। এই কুত্তীকে এখন থেকে আর আমি ঘুমুতে দেব না। তার ফল কি হবে জানিস তো? তা জানবি, তুই তো আবার ডাক্তার।
কারাস শিউরে উঠলেন। ঘুম না হলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হবে। ঘুমের দরকার খুব। ক্রিস দরজা খুলে উঁকি দিল। ভয়ে তার মুখ সাদা হয়ে গেছে।
এই যে এসেছে, ধাড়ী কুত্তীটা এসেছে। আয় আয়, দেখে যা, তুই নিজের মেয়েকে কি করেছিস। তোরই জন্যে এই অবস্থা হয়েছে, বুঝলি? তুই পাগল বানিয়েছিস, তুই!
ক্রিস থর থর করে কাপতে লাগল। কারাস বললেন, ওর কথা শুনবেন না। ওর কথায় কান দেবেন না।
শুনবে, এই হারামজাদী শুনবে। ও জানে, আমি যা বলছি তা সব সত্যি।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনি চলে যান। এক মুহূর্তও থাকবেন না।
ক্রিস ছুটে বেরিয়ে গেল। ফাদার মেরিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢুকলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন, কিছু হয়েছে কি?
ফাদার মেরিন, রেগানের এখন ঘুমানো দরকার। কিন্তু ওই জিনিসটা বলছে, ওকে সে ঘুমুতে দেবে না।
ফাদার কারাস, আপনি কোন ওষুধ দিতে পারেন?
প্রচুর লিব্রিয়াম দেয়া হয়েছে, আর দেয়া ঠিক হবে না।
রেগানের কণ্ঠ থেকে বার্ক ডেনিংসের স্বর ভেসে এল।
ওহে শুনছ, পাত্রী সাহেবরা, তোমাদের নিয়ে দেখি মহাবিপদ হল। মেয়েটা তো মরতে বসেছে, এখন আমরা যাই কোথায়? জায়গার বড় টানাটানি। তাছাড়া এখানে থাকার অধিকার আছে আমার। এই শালীর বাচ্চা শালীই তো আমাকে মেরেছে।
কারাস জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে মেরেছে?
সে তো, ভাই, লম্বা গল্প। দিব্যি স্টাডিতে বসে পান করছিলাম, হঠাৎ শুনি। খট খট শব্দ। ভয় ধরে গেল, বুঝলে? আস্তে আস্তে উঠলাম দোতলায়। উঠে দেখি…
কি দেখলেন?
ফাদার মেরিন কড়া গলায় বললেন, কারাস, প্লীজ; কথা বলবেন না, প্লীজ।
আহ, এই বুড়ো শালাকে নিয়ে যন্ত্রণা। তুই চুপ থাক না, শালা।
ফাদার মেরিন আবার প্রার্থনা শুরু করলেন। অসম্ভব শীতল হয়ে গেল ঘর। গরম কোর্টের নিচেও ঠক ঠক করে কাপতে লাগলেন কারাস। ঘরের উজ্জ্বল আলোও কেমন যেন কমে আসছে বলে মনে হল। ভয় পাওয়া গলায় বললেন, যে করেই হোক ওকে ঘুম পাড়াতে হবে। ফাদার কারাস এক সময় ঘুমের জন্যে নিজের অজান্তেই প্রার্থনা শুরু করলেন– ঘুম দাও, হে পরম প্রভু, এই মেয়েটার চোখে ঘুম দাও। ঘুম দাও। হে মহাশক্তিধর পরম পবিত্র জগৎ-প্রভু, ঘুম দাও।
ঘুম কিন্তু এল না।
ভোর হল। আবার সন্ধ্যা হল। আবার এল রাত।
ফাদার মেরিন এক সময় বললেন, আপনাকে বড়ই ক্লান্ত মনে হচ্ছে, কারাস।
আমি এর আগেও দুরাত ঘুমুতে পারিনি, ফাদার।
আপনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আসুন।
রেগান এই সময় বৃদ্ধার গলায় কথা বলে উঠল, ডিমি, ও ডিমি, তুই কেন। আমার সাথে এরকম করলি। কেন আমাকে ফেলে গেলি? কি করেছিলাম আমি? ও বেটা, ও ডিমি, কেন এ-রকম করলি? এখন আমার যাওয়ার জায়গা নেই। আমি শুধু ঘুরি। ডিমি।
কারাস চমকে গেলেন। রেগানের কণ্ঠে তার মায়ের স্বর।
ফাদার মেরিন কঠিন স্বরে বললেন, শুনবেন না, ওর কথা শুনবেন না, আপনি বিশ্রাম নিয়ে আসুন। যান।
কারাস ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। কফি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে কিন্তু তার চেয়েও অনেকক্ষণ ধরে গোসল করার বেশি ইচ্ছা হচ্ছে। সারা শরীরে কেমন যেন অশুচির। স্পর্শ। নিজের ঘরে গিয়ে গোসল সেরে এক কাপ কফি খেয়ে ফিরবেন, কিন্তু এত রাতে ক্রিসকে বিরক্ত করতে ইচ্ছা হল না।
রেসিডেন্স হলের রিসেপশন রুমে কিণ্ডারম্যান বসে ছিল। ফাদার কারাসকে দেখে সে উঠে দাঁড়াল।
মিঃ কিণ্ডারম্যান, এত রাতে আমার কাছে?
হ্যাঁ ফাদার, আপনার কাছেই।
কি ব্যাপার বলুন তো?
আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি ফাদার। প্রশ্নটা করবার আগে আমার এক খালার গল্প বলছি। এই খালা তার স্বামীকে দারুণ ভয় পেত। স্বামী রাগারাগি করত, বকা ঝকা করত, আর আমার খালার কাছে যখন সেসব অসহনীয় মনে হত তখন সে দৌড়ে চলে যেত তার আলনার কাছে। আলনার ঝুলন্ত কাপড়গুলোকে তার দুঃখের কথা বলে মনে শান্তি পেত। আমারও ঠিক সেই রকম অবস্থা। কাউকে আমার কিছু বলা দরকার, ফাদার।
তাহলে আমি এখন আপনার আলনার কাপড়?
হ্যাঁ, কিন্তু এই কাপড়কে আমার প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।