কারাস অসংখ্যবার টেপটা বাজালেন। অস্পষ্ট শব্দগুলো ধরতে চেষ্টা করলেন। ধরা গেল না। সে-রাতে তার একটুও ঘুম হল না। রেগানের গলার স্বরে এমন কিছু ছিল যা তাকে পুরোপুরি অভিভূত করে ফেলল।
পরদিন সকাল নটায় ফাদার কারাস জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করে একটি এক্সরসিজম করার অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, তাকে অনুমতি দেয়া হল।
সকাল দশটায় তিনি বিশপের কাছে গেলেন। বিশপ গভীর মনোযোগের সঙ্গে কারাসের বক্তব্য শুনলেন। এক সময় বললেন, আপনি কি নিশ্চিত? সত্যিই কি শয়তানের আছর হয়েছে মেয়েটার ওপর?
সরাসরি কোন উত্তর দিলেন না কারাস। শান্তস্বরে শুধু বললেন, আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বুঝেছি, এক্সরসিজমই হচ্ছে এখন সবচেয়ে ভাল পথ।
আপনি নিজেই তা করতে চান?
হ্যাঁ।
আপনার স্বাস্থ্য কেমন?
ভাল।
এ-ধরনের কিছু আগে কখনো করেছেন?
না।
ঠিক আছে, আপনি এখন যান। আমরা আপনাকে খবর দেব। তবে আমাদের মনে হয়, এমন কাউকে সঙ্গে নেয়া উচিত যার এ ব্যপারে পূর্ব, অভিজ্ঞতা আছে।
আপনার পরিচিত এমন কেউ কি আছেন?
হ্যাঁ, ফাদার মেরিন ল্যাংকাস্টারে আছেন।
ফাদার মেরিন? তিনি ইরাকে আছেন বলে জানতাম।
ছিলেন। এখন উডস্টকে আছেন।
তাঁর তো অনেক বয়স?
হ্যাঁ, অনেক। স্বাস্থ্যও দুর্বল। তবু তাকে বলতে হবে। এটাই নিয়ম।
উডস্টক সেমিনারী। মেরীল্যাণ্ড।
বৃদ্ধ ফাদার মেরিন মৃদু পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন। বড় বড় গাছে জায়গাটা ছায়াচ্ছন্ন। ফাদার মেরিন লক্ষ্য করলেন, সেমিনারীর একজন ছাত্র তার দিকে আসছে। ছাত্রটি টেলিগ্রামের লাল খাম ফাদার মেরিনের হাতে দিতেই তিনি মৃদু স্বরে তাকে ধন্যবাদ জানালেন।
টেলিগ্রামটা তিনি পড়লেন না। পকেটে রেখে আগের মত হাঁটতে থাকলেন। তিনি জানেন টেলিগ্রামটাতে কি লেখা। অনেক দিন ধরেই এর জন্যে তিনি প্রতীক্ষা করে আছেন। দেখা হবে, আবার দেখা হবে।
ছোট্ট একটা পাখি গলা কাপিয়ে গান করছে। ফাদার মেরিন গাঢ় ভালবাসা নিয়ে পাখিটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।
কান্নার সমর্পণ
৪.১
একজন লম্বামত বুড়ো লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।
ক্রিস বেশ অবাক হল। এত রাতে কে আসবে? ফাদার কারাস সন্ধ্যাবেলাতেই এসেছেন। তিনি আছেন রেগানের ঘরে। কিণ্ডারম্যান নয় তো? পুলিশ অফিসারটি যে তার বাড়ির ওপর কড়া নজর রাখছে, তা ক্রিস বেশ বুঝতে পারে। কয়েকবার দেখা হয়েছে রাস্তায়। কিণ্ডারম্যান এমন ভাব করেছে যেন এই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখা। কিন্তু যে এসেছে সে কিণ্ডারম্যান নয়। কিণ্ডারম্যান বেঁটে, বুড়ো অনেক লম্বা। ক্রিস দরজার কাছে এসে অপরিচিত লোকটার দিকে অবাক হয়ে তাকাল। লোকটা অন্ধকারে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় লম্বা একটা টুপি। তাতে মুখ ঢাকা পড়ে আছে।
কি করতে পারি আপনার জন্যে?
মিসেস ম্যাকনীল?
হ্যাঁ।
লোকটা মাথার টুপি খুলে ফেলল। ক্রিস স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইল। লোকটির চোখ দুটো কি শান্ত। মুখাবয়বে গাঢ় বিষাদ ও প্রশান্তি। যেন উনি পৃথিবীর সাধারণ মানুষ হয়েও পৃথিবীর নন।
মিসেস ম্যাকনীল, আমি ফাদার মেরিন ল্যাংকাস্টার।
সম্বিৎ ফিরে পেতে ক্রিসের বেশ কিছু সময় লাগল। ইনিই ফাদার মেরিন? কি আশ্চর্য!
ফাদার, আমি বুঝতেই পারিনি আপনি এত তাড়াতাড়ি আসবেন! আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়ত আসবেন পরশু নাগাদ।
আমি জানি।
ফাদার মেরিন ঘরে ঢুকলেন। ক্রিসের মনে হল ঘরে পা দিয়েই তিনি কি যেন বুঝতে চাইছেন, অনুভব করতে চাইছেন। মনে মনে যেন কিসের হিসেব মিলাচ্ছেন। তার কপালে সূক্ষ একটা কুঞ্চন।
ফাদার মেরিন, আপনার স্যুটকেসটা বরং আমার হাতে দিন।
না, ঠিক আছে। ফাদার কারাস কি এ-বাড়িতে আছেন?
হ্যাঁ, এতক্ষণ রেগানের ঘরে ছিলেন, এখন রান্নাঘরে। ফাদার, আপনি কি রাতের খাবার–
না, আমি খেয়ে এসেছি।
চা কিংবা কফি?
না, মিসেস ম্যাকনীল। আমার জন্যে ভাববেন না।
আমি যদি জানতাম আপনি আসছেন তাহলে স্টেশনে থাকতাম।
আমার কোন অসুবিধা হয়নি।
আপনার জন্যে একটা ঘর আমরা গুছিয়ে রেখেছি। এখন বিশ্রাম নিন। নকি ফাদার কারাসের সঙ্গে কথা বলবেন?
আমি আপনার মেয়েকে একটু দেখব।
এখনই?
হ্যাঁ।
ফাদার, রেগান এখন ঘুমুচ্ছে। তাকে লিব্রিয়াম দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই ঘুম পাড়ানো হয়েছে।
আমার তা মনে হয় না। মিসেস ম্যাকনীল, ও জেগেই আছে।
ফাদার মেরিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই রেগানের ঘর থেকে বিকট চিৎকার ভেসে এল। প্রচণ্ড সেই আওয়াজে ঘরের কাচের জানালায় যেন ধাক্কা লাগল। দ্বিতীয়বার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে রেগানের ঘর থেকে ভাঙা গলায় কেউ একজন ডাকল–মেরিন …-মেরি … ই-ই-ই-ন!।
ফাদার মেরিন মাথা তুলে দোতলার সিঁড়ির দিকে তাকালেন। তার মুখ দেখে ক্রিসের মনে হল, তিনি জগৎ-সংসার ভুলে গেছেন। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন ফাদার মেরিন। ইতিমধ্যে কারাস রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ক্রিসের পাশে দাঁড়িয়েছেন। রেগানের ঘর থেকে তখন হাঁ-হাঁ জাতীয় একটা বিকট শব্দ ভেসে আসছে।
ফাদার মেরিন রেগানের ঘরে ঢোকামাত্র চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দুজন দুজনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকল। এক সময় রেগানের মুখ থেকে কঠিন স্বরে কেউ একজন কথা বলল, মেরিন, তুমি তাহলে এসেছ?
ফাদার মেরিন কোন উত্তর দিলেন না।
মেরিন, এইবার তুমি হারবে। নিশ্চয়ই হারবে।