কারাস বললেন, তুমি কে?
মিয়াউকেইন।
এটা কি তোমার নাম?
বিড়বিড় করে এর উত্তর দেয়া হল।
আমার কথা কি বুঝতে পারছ?
অস্পষ্ট উত্তর। সেই অচেনা ভাষা।
কারাস আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। বিড়বিড় করতে করতে রেগান এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল।
কারাস নিচে নেমে এসে দেখেন, সোফায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে শুয়ে আছে ক্রিস। দুচোখ বোজা। পায়ের শব্দে জেগে উঠে বসল সঙ্গে সঙ্গে।
ফাদার, আপনাকে কফি না চা দেব?
না, ধন্যবাদ। মিসেস ম্যাকনীল, আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।
বলুন।
আপনার মেয়ের অসুখটা সম্পূর্ণ মানসিক। শয়তান-টয়তান কিছু নয়। এক্সরসিজম করার পরিকল্পনা বাদ দিতে হবে।
আজ হঠাৎ এই কথা বলছেন কেন?
আমি ওর গায়ে হলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিতেই ও বিকট চিৎকার শুরু করে দিল।
তাতে হয়েছে কি?
আসলে ওটা হলি ওয়াটার ছিল না। সত্যিকার শয়তান হলে প্রভেদটা বুঝতে পারত।
হয়ত এই শয়তানটা দুয়ের মধ্যে প্রভেদ জানে না।
মিসেস ম্যাকনীল, আপনি তাহলে পুরোপুরি বিশ্বাস করেন যে রেগানের মধ্যে সত্যি সত্যি শয়তান আছে?
ফাদার, আপনি করেন না? সত্যি করে বলুন, করেন না?
কারাস কোন জবাব দিলেন না। ক্রিস কাদতে শুরু করল। তখন ক্রিসের হাতের ওপর একটা হাত রেখে কারাস কোমল স্বরে বললেন, প্রগানের রিপোর্টগুলো আমার হাতে আসার পর আমি চার্চের কাছে পুরো বিষয়টা তুলে ধরব। মিসেস ম্যাকনীল, গোটা বাপারটাই বড় রহস্যময়। একবার আমার মনে হয়, এটা একটি ভয়ংকর মানসিক অসুখ; আবার মনে হয়, মেয়েটির মধ্যে শয়তান থাবা মেলে বসে আছে।
ঘর থেকে বেরিয়েই কারসি এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্য দেখলেন। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের কাছে দাঁড়িয়ে কার্ল একদৃষ্টে রেগানের ঘরের বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। কারাসকে দেখেই সে চমকে উঠল।
কেমন আছ, কার্ল?
ভাল। আমি ভাল আছি। বলেই দ্রুত পায়ে সে হাঁটতে শুরু করল যেন সামনে থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাচে। কারাস বেশ অবাক হলেন।
কার্ল প্রথমে গেল বাসস্টাণ্ডে, সেখান থেকে বাসে উঠে, দুতিনবার বাস বদলে শহরের সর্বদক্ষিণ প্রান্তে এসে উপস্থিত হল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে যেখানে গিয়ে শেষ পর্যন্ত থামল সে জায়গাটা শহরের দরিদ্রতম অঞ্চল। চারদিকে জীর্ণ কদাকার সব ফ্ল্যাট বাড়ি। রাস্তার দুপাশে আবর্জনার স্থূপ।
একটা ভাঙাচোরা দোতলা বাড়ির লোহার সিঁড়ির নিচে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে সে ক্লান্ত পায়ে ওপরে উঠতে থাকল। তারপর একটা বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে ডাকল, এলভিরা, এলভিরা।
দরজা খুলে আলুথালু পোশাকের বিশ—একুশ বছরের একটা মেয়ে মুখ বের করল। ঘরের ভেতর থেকে কর্কশ পুরুষ গলা শোনা গেল, বিদায় কর, মাগী। পয়সা দিয়ে এসেছি।
এলভিরা কড়া ধমক লাগাল, চুপ কর। আমার বাবা এসেছে।
কার্ল ধরা গলায় বলল, কেমন আছিস, মা?
ভাল। ভেতরে এস না কিন্তু, হারামজাদাটা নেংটো হয়ে বসে আছে। তুমি টাকা এনেছ।
কার্ল পকেট থেকে টাকা বের করল। এলভিরা ছোঁ মেরে টাকাগুলো নিয়ে নিল।
ওইসব আজেবাজে ইনজেকশানগুলো নিস না। তোকে আমি নিউইয়র্কের একটা ক্লিনিকে নিয়ে যাব। ওরা সারিয়ে দেবে। তখন ভদ্রভাবে জীবন কাটাতে পারবি।
আহ কি ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ শুরু করলে? এখন যাও তো, ঘরে আমার লোক আছে?
মা, লক্ষ্মী মা আমার, কথা শোন … কার্ল মেয়ের হাত ধরে ফেলল।
এলভিরা ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কি যে ঝামেলা কর প্রতিবার।
ভেতর থেকে লোকটি চেঁচাল, ঘাড় ধরে বের করে দে না!
এলভিরা সঙ্গে সঙ্গে কার্লের মুখের ওপর সশব্দে দরজা বন্ধ করে দিল।
ক্লান্ত পায়ে সিড়ি দিয়ে নেমে এসে কার্ল দেখে, রাস্তার অন্য পারে কিণ্ডারম্যান দাঁড়িয়ে আছে। কার্লকে দেখে সে গম্ভীর স্বরে বলল, মিঃ কার্ল, এখন মনে হয় আপনি আমার সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে পারেন, তাই না?
কিণ্ডারম্যানের হাত দুটি পকেটের ভেতর। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ।
৩.২
কারাস দেখা করতে গেলেন ভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ম্যাকফ্রাঙ্কের সঙ্গে। রেগানের অদ্ভুত ভাষায় কথার টেপটা তিনি বাজিয়ে শোনালেন তাঁকে।
ফ্রাঙ্ক, এটা কি কোন ভাষা, না প্রলাপ?
টেপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ম্যাক ফ্রাঙ্ক চোখ বন্ধ করে শুনলেন। তার মুখের ভঙ্গিতে বিস্ময় ফুটে উঠল।
এটা তুমি কোথায় পেয়েছ?
পেয়েছি এক জায়গায়। এখন বল এটা কি? কোনও প্রাচীন ভাষা?
হতে পারে। আমি কখনো শুনিনি। আরেকবার বাজাও তো শুনি।
দ্বিতীয়বার বাজান হল টেপটা।
খুবই অদ্ভুত। আমার কাছে রেখে যাও। আমি দেখব কিছু করা যায় কি না।
ফ্রাঙ্ক, আমার আরেকটা ব্যাপার জানতে হবে।
বল।
আমি একই লোকের দুধরনের কথা তোমাকে শোনাব। তুমি কি কোনভাবে বলতে পারবে একই লোকের পক্ষে সম্পূর্ণ দুই ভঙ্গিতে কথা বলা সম্ভব কি না?
হ্যাঁ, পারব। একই লোক হলে বলে দিতে পারব।
কিভাবে?
আমি টাইপ টোকেন অনুপাত বের করব। ধরো, এক হাজার শব্দের ভেতর কোন একটা বিশেষ শব্দ কতবার আসছে তা দেখা আর বাক্য গঠনরীতি পরীক্ষা করা।
ফ্রাঙ্ক, তোমার কি মনে হয় এই পদ্ধতিটা নির্ভুল?
অবশ্যই। তুমি টেপটা রেখে যাও। আমি ইন্সট্রাকটরকে বলব পরীক্ষা করতে।
ফ্রাঙ্ক, তোমাকেই এ কাজটা করতে হবে, আর আজই করতে হবে। খুবই জরুরী। প্লীজ ফ্রাঙ্ক।
ঠিক আছে।
বাকি দিনটা কারাস কাটালেন জর্জটাউন লাইব্রেরিতে। সাইকোকাইনেটিক বিষয় সম্পর্কে যত বই পাওয়া গেল সব নামিয়ে এনে বসলেন। বিকাল চারটের দিকে তিনি নিশ্চিত হলেন যে সাইকোকাইনেটিক ব্যাপারটা কোন মনগড়া কিছু নয়। বহু দলিলপত্র, প্রমাণাদি আছে এর। বয়ঃসন্ধিকালে তীব্র মানসিক দুঃখবেদনা, রাগ-অভিমান সাইকোকাইনেটিক শক্তির (যার ধরন এখনো অজানা) জন্ম দিতে পারে। ফলস্বরূপ দেখা যায় রোগীর চারপাশে টেবিল-চেয়ার নড়ছে। কাগজপত্র, কলম, কলমদানী শূন্যে উড়ছে।