অবশ্যি এই পাত্রীটি মাথা নিচু করে কেমন যেন দিশেহারা ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে আকাশের দিকে। বৃষ্টি হবে কি হবে না তাই বোধহয় দেখছে।
বার্ক বলল, ক্রিস, তুমি রেডি?
রেডি।
লাইট … সাউণ্ড… রোল…
ক্রিস মুখের রেখায় একটা কঠিন ভাব ফুটিয়ে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র আলো এসে পড়ল ওর মুখের ওপর। বাকের চিঙ্কার শোনা গেল। স্পীড … অ্যাকশন!
ক্রিস দৌড়ে গেল খানিকটা, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে সিড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। ওর পিছে পিছে স্ক্রিপ্ট হাতে ছুটছে প্রম্পটার, মৃদুস্বরে ডায়ালগ মনে করিয়ে দিচ্ছে। এত ব্যস্ততার মধ্যেও একফাকে চোখ সরিয়ে ক্রিস দেখল, ভিড়ের মধ্যে থেকে পাদ্রীটি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। পাদ্রীর চোখে-মুখে এক ধরনের বিষণ্ণতা।
বিকাল চারটে পর্যন্ত শুটিং চলল। তারপর মেঘ জমতে শুরু করল আকাশে। ঘন কাল মেঘ। এত কম আলোয় শুটিং হয় না। আজকের মত প্যাক-আপ করা ছাড়া উপায় নেই।
ক্রিস ক্লান্তিতে ভেঙে পড়েছে। শরীরে চটচটে ঘাম। এতটুক হেঁটে বাড়ি ফিরতেও কষ্ট হচ্ছে। ছত্রিশ নম্বর সড়কের মাথায় আসতেই চোখে পড়ল ক্যাম্পাসের লাগোয়া ক্যাথলিক চার্চটি পাদ্রীতে গিজগিজ করছে। পেছন থেকে দ্রুত পায়ে কাল পোশাক পরা একজন পাদ্রী এগিয়ে এসে ক্রিসকে পেছনে ফেলে হাঁটতে লাগল। বাচ্চা বয়স ছেলেটির। গালভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি। হাত দুটি পকেটে ঢুকিয়ে কেমন যেন হড়বড় করে হাঁটছে।
ক্রিস একটু অবাক হয়েই তাকিয়ে রইল তার দিকে। চার্চে না ঢুকে পাদ্রীটি যাচ্ছে ধবধবে সাদা রঙের একটা কটেজের দিকে। অন্য একজন পাদ্রী ইতিমধ্যে কটেজের দরজা খুলে বাইরে এসেছে, কি যেন কথা হল দুজনের মধ্যে। দ্বিতীয় পাদ্রীটির মুখ লম্বাটে ও মলিন। কেমন যেন দিশেহারা ভঙ্গি। আবার কে একজন কটেজের দরজা খুলে বেরিয়ে এল। আশ্চর্য, সে-ও একজন পাদ্রী। কি হচ্ছে এখানে আজকে? ক্রিস তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল। শুটিংয়ের সময় এই পাদ্রীই দাঁড়িয়ে ছিল না? বিষণ্ণ চোখে এইতো তাকিয়ে ছিল তার দিকে।
আকাশে ঘন ঘন বিজলি চমকাচ্ছে। অনেক দূর থেকে আসছে মেঘ ডাকার গম্ভীর শব্দ। রাতে নিশ্চয়ই খুব ঝড়-বৃষ্টি হবে। হোক, ঝড় হোক। বৃষ্টিতে ভাসিয়ে নিয়ে যাক সবকিছু।
ক্রিস মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল। গোসল সেরে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে শ্যারন স্পেনসার বসে আছে। গত তিন বছর ধরে শ্যারন ক্রিসের সেক্রেটারী
আর রেগানের টিউটর হিসেবে কাজ করছে।
কেমন কাটল, ক্রিস? শ্যারনের মুখে-চোখে চাপা হাসি।
রোজ যেমন কাটে। তা, কোন খবর আছে আমার?
শ্যারন রহস্যময় ভঙ্গিতে বলল, হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ডিনার খেতে চাও? সামনের হপ্তায়?
জানি না খেতে চাই কি না। রেগান কোথায়?
নিচে। খেলছে।
এখন আবার কি খেলা?
মূর্তি বানাচ্ছে। তোমাকে উপহার দেবে।
ক্রিস পট থেকে কফি ঢেলে বলল, হোয়াইট হাউজে ডিনারের ব্যাপারটা সত্যি, না ঠাট্টা করছো?
বা-রে, ঠাট্টা করব কেন? সামনের বিষুদবারে, বিকেল তিনটেয়।
বড় পার্টি নাকি?
না, খুব বড় নয়।
সত্যি? বাহ!
ক্রিস খুশি হল তবে তেমন অবাক হল না। অনেকেই ওর সঙ্গ পছন্দ করে। সে সুন্দরী, নামী অভিনেত্রী। তার ফ্যানদের মধ্যে ট্যাক্সী ড্রাইভার, ভবঘুরে কবি থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীরাও আছে। হোয়াইট হাউজের ডিনার খুব বড় ব্যাপার না। ক্রিস মৃদু স্বরে বলল, রেগানের পড়াশুনা কেমন চলছে?
শ্যারন একটা সিগারেট ধরিয়ে হালকা সুরে বলল, অংক নিয়ে আবার খানিকটা ঝামেলা হয়েছে।
আবারও?
হ্যাঁ, আশ্চর্য হওয়ারই কথা। অংক ওর পছন্দের বিষয় ছিল। আর এখন সামান্য জিনিসও…।
মা! রেগান হাসি মুখে এগিয়ে আসছে। মাথার ঝাকড়া চুল পেছনে টেনে বেঁধে পনি টেল করেছে। আনন্দ উত্তেজনায় চোখ-মুখ ঝলমল করছে। ক্রিস মেয়েকে জড়িয়ে ধরল। আজ কি করেছো সারাদিন, মা-মণি?
কিচ্ছু করিনি।
কিছুই না?
দাঁড়াও, একটু ভেবে দেখি। হুঁ, পড়েছি!
আর?
ছবি এঁকেছি।
আর?
আর আর কিছু করিনি।
ক্রিস হাসিমুখে বলল, কই, আমার জন্যে মূর্তি বানাওনি?
রেগান কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর শ্যারনের দিকে তাকাল খানিক রাগের দৃষ্টিতে। তার গোপন ভাস্কর্যের কথা এমনভাবে প্রকাশ হয়ে পড়বে, সে ভাবেনি।
ওটা এখনো শেষ হয়নি। রঙ করতে হবে। রেগান আদুরে গলায় বলল, বড় ক্ষিধে পেয়েছে, মা। চল না আজ বাইরে গিয়ে খাই।
ক্রিস নরম গলায় বলল, বেশ তো, চল আজ বাইরেই খাব। জামাটা বদলে আস।
আমি তোমাকে খু-উ-ব ভালবাসি, মা।
আমিও তোমাকে ভালবাসি, মা-মণি। নতুন যে জামাটা কিনে দিয়েছি সেদিন, নীল রঙের, ঐটা পরবে, কেমন?
রেগান ঘরে ছেড়ে চলে যেতেই শ্যারন বলল, এগারো বছরের খুকী হতে ইচ্ছে করে তোমার?
আমার এখনকার যে বুদ্ধিশুদ্ধি আছে তাই নিয়ে, না এগারো বছরের মেয়ের বুদ্ধি নিয়ে?
এখনকার বুদ্ধি, আর তোমার যতো স্মৃতি আছে সব নিয়ে।
উহুঁ, কাজটা বড় কঠিন।
ভেবে দেখ।
ভাবছি।
ক্রিস সকালের ডাকে আসা চিঠিপত্র উল্টে দেখতে লাগল। একটা মোটামত খাম হাতে নিয়ে বলল, এটা কি, শ্যারন? কোন নতুন স্ক্রিপ্ট? বলেছি তো আমি আর কোন নতুন স্ক্রিপ্ট এখন নেব না। আমি সত্যি খুব ক্লান্ত। আর পারছি না!
ওটা পড়ে দেখ, ক্রিস। মন দিয়ে পড়।
তুমি পড়েছো?
হ্যাঁ, আজ সকালে পড়লাম।
ভাল?
ভাল বললে কম বলা হয়। অসম্ভব ভাল।