ক্রিস একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। কারাসের কথা শেষ হতেই বলল, আমি আমার মেয়েকে চিনি। তার যত পরিবর্তনই হোক তাকে আমি চিনব। অবিকল রেগানের মত লক্ষ কোটি মেয়েকে আমার সামনে এনে দাঁড় করালেও আমি আমার মেয়েকে চিনে বের করতে পারব। ফাদার, আমার কথা আপনি বিশ্বাস করুন, দোতালায় যে এখন শুয়ে আছে সে সত্যিই রেগান নয়।
কারাস শান্ত স্বরে বললেন, চট করে কিছু ভেবে বসা ঠিক হবে না।
চট করে আমি কিছু বলছি না। ওই জিনিসটার সঙ্গে তো আপনি নিজেও কথা বলেছেন। ওর অস্বাভাবিক বুদ্ধি লক্ষ্য করেন নি?
দ্বিতীয় সত্তাটি প্রায় সব ক্ষেত্রেই বুদ্ধিমান হয়। প্রফেসর জাং, ফ্রয়েডের বিখ্যাত ছাত্র, একথা লিখে রেখে গেছেন।
রাখুন আপনার জাং আর ফ্রয়েড। আমি এসব আর শুনতে চাই না। যথেষ্ট শুনেছি।
কারাস হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি আজ উঠব। আমার একটা লেকচার আছে। তবে আবার আসব। যতদিন না আপনার মেয়ে সুস্থ হয় আপনি আমাকে পাবেন।
ক্রিস কিছু বলল না।
আপনি আমাকে রেগানের মেডিকেল রেকর্ড দিতে পারেন?
দেখুন ফাদার, আমি ওসব একদফা শেষ করে এসেছি।
শেষ করলেও আমার লাগবে। ধর্মীয় পদ্ধতিতে শয়তান তাড়াবার ব্যবস্থা করতে হলেও ওর মেডিকেল রেকর্ড আমার লাগবে। গির্জার অনুমতির জন্যে আমার প্রমাণ করতে হবে রেগানের মধ্যে সত্যি কিছু একটা ভর করেছে। কবে নাগাদ আনাতে পারবেন সেসব?
তাড়াতাড়ি আনাবার জন্যে যদি আমার একটা প্লেনও ভাড়া করতে হয় আমি তা করব, ফাদার।
আর ওর কথাবার্তার টেপ দরকার। আগে ওর কথা কেমন ছিল আমি শুনতে চাই।
আমি এনে দিচ্ছি। জন্মদিনে ওর বাবাকে পাঠাবার জন্যে ও একটা ক্যাসেট টেপ করেছিল।
বিদায় নেয়ার আগে কারাস বললেন, আচ্ছা মিসেস ম্যাকনীল, আপনি কি জানেন যে কিছুদিন আগে আমার মা মারা গেছে?
জানি। আমি খুব দুঃখিত, ফাদার।
আপনার মেয়ে কি জানে?
না তো। সে জানবে কোত্থেকে?
কারাসের ভ্রু কুঁচকানো দেখে ক্রিস উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল, এসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?
ঘর থেকে বেরিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে কারাস রেগানের জানালার দিকে তাকালেন। তিনি অকারণেই কেমন অস্থিরতা অনুভব করলেন। তাঁর মনে হল পর্দা ঘেরা ওই বন্ধ জানালাটার ওপাশ থেকে কেউ যেন তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। অনেকক্ষণ অভিভূতের মতই দাঁড়িয়ে থাকলেন তিনি।
কারাস সরাসরি নিজের ঘরে গেলেন না। প্রথমে গেলেন জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরিতে। গাদাখানেক বই আর পত্র-পত্রিকা ইস্যু করলেন। তারপর ঘরে ফিরে সিগারেট ধরিয়ে ভাবতে বসলেন।
বেগনের যা হয়েছে তাকে কি সত্যি সত্যি হিস্টিরিয়া বলা চলে? সে কি করে তাঁর মায়ের কথা জানল? কি করে নিউইয়র্ক সাবওয়ের সেই বিকলাঙ্গ ভিখিরির গলায় কথা বলল? চিন্তিত মুখে কারাস লাইব্রেরি থেকে আনা বইগুলোর পাতা উল্টাতে লাগলেন। অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একসময় দ্য রোমান রিচুয়ালস বইটা খুলে শয়তান সম্পর্কিত অংশটিতে চোখ বুলাতে লাগলেন :
কেউ যেন প্রথমে ভূতে পাওয়ায় বিশ্বাস না করেন। শয়তানের ভর সত্যি সত্যি হয়েছে কি না তা আগে সঠিকভাবে জানতে হবে। লক্ষণসমূহ বিশ্লেষণ করতে হবে। যখন কাউকে শয়তানে ধরে তখন সে সাধারণত বিচিত্র ভাষায় কথা বলতে পারে এবং ভবিষ্যতের ঘটনাসমূহ বলতে পারে। শয়তান অবশ্যই তার অস্বাভাবিক ক্ষমতার পরিচয় দেবে। সেই সঙ্গে তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রমাণও পাওয়া যাবে…
ভূতে পাওয়ার ওই লক্ষণগুলো রেগানের লক্ষণগুলোর সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু ক্রিস বলেছে–পরকাল বিষয়ক একটা বই পড়েছে রেগীন। সে বইটা কি রেগানের দুর্বল মনে কোন প্রভাব ফেলেনি? আচ্ছা, রেগানের অস্বাভাবিকতাগুলোকে একটা একটা করে বিশ্লেষণ করা যাক। কারাস কাগজ কলম নিয়ে বসলেন।
১। রেগানের চেহারার বিকৃতি : অসুখের জন্যে হতে পারে। শরীর মনের ছায়া। শারীরিক অসুস্থতা চেহারায় ধরা পড়বেই।
২। রেগানের গলার স্বরের পরিবর্তন : আগেরকার গলার স্বর শোনা হয়নি। কাজেই কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে তা বলা সম্ভব নয়। তাছাড়াও দিনরাত বিকট স্বরে চিৎকার করলে স্বরতন্ত্র মোটা হবেই।
৩। রেগানের কথা বলার ধরন এবং সাধারণ জ্ঞানের নতুন বিস্তৃতি : ক্রিপটোমেনসিয়া।
৪। রেগান তাঁকে পাদ্রী হিসেবে চিনতে পেরেছে, যদিও তার গায়ে কোন পোশাক ছিল না : অনুমান করে বলেছে। সৌভাগ্যক্রমে এই ক্ষেত্রে অনুমান সত্যি হয়েছে।
৫। রেগান ধরতে পেয়েছে যে তার মা মারা গেছে : এটাও অনুমান। আমার বয়স চল্লিশ, আমার মা বেঁচে না থাকারই কথা।
৬। কথাবার্তায় রেগানের ক্ষুরধার বুদ্ধি : দ্বৈতসত্তার আবির্ভাব ঘটলে দ্বিতীয় সত্তাটি সচরাচর অত্যন্ত বুদ্ধিমান হয়। এ বিষয়ে জাং-এর অভিমত সঠিক। কারাস কাগজ কলম সরিয়ে রেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। রেগানের কথার যে টেপটি এনেছেন সেটা রেকর্ডারে চালু করলেন। রেগানের গত জন্মদিনে টেপটা করা হয়েছিল তার বাবাকে পাঠাবার জন্যে। রিনরিনে মিষ্টি গলা :
বাবা আমি কথা বলছি (হাসি)। কিছু মনে আসছে না। মা, কি বলব? (হাসি) (মায়ের গলা) বল, সারাদিন কি করলে। (হাসি) বাবা শোন, উমম, শোন আমার … কথা শুনতে পাচ্ছ? (হাসি) কোথায় গিয়েছিলাম জান তুমি? … আচ্ছা, প্রথম থেকে শুরু করি, উমম
(হাসি)।
টেপ বন্ধ করে কারাস নিজের মনেই বললেন, রেগানের ঘরে যে বসে আছে সে রেগান নয়, হতেই পারে না।