ঘরের হিটারটা কি কাজ করছে না? না, তা নয়। হিটার বেশ গরম। ঘরের দুটি জানালাই বন্ধ। তাহলে এমন ঠাণ্ডা লাগছে কেন? ক্রিস রেগানের গালে হাত রাখল উষ্ণ ঘামে ভেজা নরম গাল। নিচু হয়ে রেগানের কপালে চুমু খেল। আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি, মা, মৃদুস্বরে এই কথা কটি বলেই ক্রিস ভাবল, আমারই কোন অসুখ করেছে নিশ্চয়। এজন্যেই এমন ঠাণ্ডা লাগছে।
ক্রিস দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। ভালমত পড়া দরকার চিত্রনাট্যটি।
কিন্তু পড়তে মোটেই ভাল লাগছে না। ছবিটা একেবারেই হালকা ধরনের কমেডি, সেই মিঃ স্মিথ গোজ টু ওয়াশিংটন-এর পুনঃনির্মাণ। অতি বাজে স্ক্রিপ্ট। বিরক্তিকর, উদ্ভট ডায়ালগ।
পড়তে পড়তে একসময় ক্রিসের চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। হাই ওঠে। তারপর ঘুমিয়ে যায়। গাঢ় ঘুম নয়। অস্বস্তি ভরা ছাড়া ছাড়া ঘুম। সেই সঙ্গে কিসব আজে বাজে স্বপ্ন। কেউ যেন ধারাল ছুরি হাতে ওকে মারতে আসছে। আর ও প্রাণপণে ছুটছে, চিৎকার করছে, বাবা, বাবা, আমাকে বাঁচাও। আমার কাছে আসতে দিও না। আমি মরতে চাই না। কিছুতেই না। প্লীজ, বাবা, আমাকে বাঁচাও। কোথায় যেন আবার বিকট শব্দে বাজনা হচ্ছে। স্নায়ুতন্ত্রীগুলো ঝনঝন করছে সেই শব্দে। কি কুৎসিত, কি তীব্র সে শব্দ! ক্রিস ঘেমে নেয়ে জেগে উঠল। বুক কাঁপছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথার কাছে রাখা টেলিফোন বাজছে। বেজেই যাচ্ছে। টেলিফোন ধরামাত্র সহকারী পরিচালকের ভারি গলা শোনা গেল; হ্যালো, ক্রিস?
হ্যাঁ।
আজ শুটিং, মনে আছে তো?
আছে। বাজে কটা?
ভোর হয়েছে, ক্রিস। কি ব্যাপার, তোমার শরীর খারাপ নাকি?
না তো।
ক্রিস বিশ্রী স্বপ্নটাকে মন থেকে তাড়াতে পারছে না। এমন অস্বাভাবিক স্বপ্ন! যেন ঘুমের মধ্যে নয়, জেগে জেগে দেখা। চোখে মুখে পানি দিয়ে সে নিচে নেমে এল।
গুড মরনিং, ক্রিস।
গুড মরনিং, উইলী।
উইলি কমলার রস তৈরি করছিল, ক্রিসকে দেখে এগিয়ে এল। কফি এনে দেবো?
না, থাক। আমি নিয়ে নেবো।
ক্রিস অবাক হয়ে দেখল এই সাত সকালে রেগান ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছে। কি অপূর্ব লাগছে ওকে। শান্ত গভীর চোখ। মসৃণ গোলাপী গাল। মাথাভর্তি সোনালি চুল চকচক করছে ভোরের আলোয়। ক্রিসের আচমকা মনে হল জ্যামির কথা। ছেলেটাও এমনি ছিল। যেন পথ ভুলে আসা স্বর্গের দেবশিশু। তিন বছর বয়সে মারা গেল হঠাৎ। ক্রিস তখন অখ্যাত এক নর্তকী। থাক, সেসব পুরনো কথা। ক্রিস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ধরাল। কমলালেবুর সরবতের গ্লাস এনে সামনে রাখল উইলি। ক্রিসের মনে পড়ল গত রাতের ইদুরের কথা।
কার্ল কোথায়, উইলী?
ম্যাডাম, আমি এখানে।
পেন্ট্রি রুমের দরজার পাশে দেখা গেল কার্লকে। গালে একটুকর টিস্যু পেপার চেপে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে আছে। শেভ করতে গিয়ে বোধহয় গাল কেটে গেছে। এমনিতে কার্লের চোখ অস্বাভাবিক তীব্র। খাড়া নাক। মাথায় চুলের বংশও নেই।
কার্ল, আমাদের ঘরভর্তি ইঁদুর। ওগুলো মারার ব্যবস্থা কর।
ম্যাডাম, এ বাড়িতে কোন ইঁদুর নেই।
আছে। কাল রাতে আমি নিজে ইঁদুরের শব্দ শুনেছি।
আমার মনে হয় আপনি পানির নলের শব্দ শুনেছেন। পানি আসার সময় এক ধরণের শব্দ হয়।
কার্ল, তুমি কি আমার সঙ্গে তর্ক বন্ধ করবে?
অবশ্যই না, ম্যাডাম। আমি এখনই গিয়ে ইঁদুর-মারা কল কিনবো।
এখন যেতে হবে না। দোকানপাট এখনো খোলেনি।
না খুলুক, আমি এখনই যাব।
কার্ল দ্রুত বেরিয়ে গেল। ক্রিস তাকাল উইলীর দিকে। উইলি বিড়বিড় করে বলল, লোকটা বড় অদ্ভুত! কথাটা পুরোপুরি সত্যি। তবে খুব কাজেরও। অত্যন্ত অনুগত। কিন্তু এমন কিছু আছে লোকটির মধ্যে যা ক্রিসের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি জাগিয়ে তোলে। ভাল লাগে না। কি আছে কালের মধ্যে? অবাধ্যতা? না অন্য কিছু? নিশ্চয়ই এমন কিছু যা ঠিক বোঝা যায় না। কার্ল আর উইলি দুজনেই প্রায় ছবছর হল এখানে কাজ করছে। কিন্তু এই ছবছরেও কার্লকে ঠিক বুঝতে পারা গেল না। লোকটি যেন মুখোশ পরে ঘুরে বেড়ায়। সত্যি চেহারাটা চোখে পড়ে না।
জর্জটাউন ক্যাম্পাসে শুটিং হওয়ার কথা। ক্রিস যখন পৌঁছল তখন চমৎকার রোদ উঠেছে। ঝলমল করছে চারদিক। সকাল আটটায় প্রথম শট নেয়ার কথা। আটটা এখনো বাজেনি। ক্রিসের মনের চাপা অস্বস্তি ভাবটা কেটে গেছে। লোকেশনে গিয়েই স্ক্রিপ্ট নিয়ে একটা ঝগড়া শুরু করল ও, বার্ক, তুমি কি এই ঘোড়ার ডিমের ডায়ালগগুলো পড়ে দেখেছো?
পরিচালক ডেনিংস বার্ক এক চোখ ছোট করে বলল, খুব মজাদার বুঝি?
এমন কুৎসিত জিনিস আমি জীবনেও পড়িনি। কোন্ গাজাখোর লিখেছে বল তো?
ক্রিস, আমার ময়না পাখি, কোন জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়নি শুনি?
কোন্ জায়গাটা নয়, বল! আগাগোড়া একটা যাচ্ছেতাই লেখা।
বার্ক চোখ নাচিয়ে বলল, লেখককে তাহলে খবর দিয়ে আনানো দরকার, কি বল?
সে আছে কোথায়? পালিয়েছে নাকি?
একটি ইংগিত করে বার্ক বলল, ওই শালা এখন প্যারিসে, খুব ইয়ে করে বেড়াচ্ছে।
শুটিং শুরু হওয়ার সময় ক্রিস আবার বেঁকে বসল। মুখ সরু করে বলল, দালানের ভেতর আমার দৌড়ে যাওয়ার কোন দরকার নেই। খামোকা এটা করব কি জন্যে?
স্ক্রিপ্টে আছে তা-ই করবে।
এতে কাহিনী বা ঘটনার কিছু আসবে যাবে না।
না যাক, তুমি দৌড়ে যাও তো, লক্ষ্মী সোনা চাঁদের কণা, শটটা শেষ করি।
ক্রিস হেসে ফেলল। শট নেয়া শুরু হবে এবার। মাথা ঘুরিয়ে দেখল লাইট ঠিক করা শুরু হয়েছে। টেকনিশিয়ানরা ছুটাছুটি করে এক্সট্রাদের একপাশে সারি বেঁধে দাড় করিয়ে দিচ্ছে। ক্রিস অবাক হয়ে দেখল কাল পোশাক পরা এক পাদ্রী দাঁড়িয়ে আছে ভিড়ের মধ্যে। অল্প বয়েসী কোন ফাদার। কিন্তু এখানে কি জন্যে? পাদ্রীরা ছবির শুটিং দেখবে কেন?