মোতালেবের পরিকল্পনা হলো। জোছনা রাতে—ঠিক বারটা এক মিনিটে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করার জন্যে সভ্যতার সমস্ত সংশ্ৰব বিসর্জন দিতে হবে; অর্থাৎ জামা-কাপড় সব খুলে আদি মানব হতে হবে। তারপর সমুদ্রের জলে নেমে যাওয়া। প্রকৃতির পরিপূর্ণ অংশ হয়ে যাওয়া। মাঝে-মাঝে জল থেকে উঠে সমুদ্রের ধার ঘেঁষে ছুটে যাওয়া হবে। বালিতে গড়াগড়ি করা হবে। আবার পানিতে নেমে যাওয়া। এ রকম চলবে সারা রাত। ঠিক সূর্য উঠার পর পর সভ্য জগতে ফিরে আসা হবে। জামাকাপড় গায়ে দেয়া হবে।
মোতালেবের পরিকল্পনাটা যেমন বর্ণনার ভঙ্গি তারচে অনেক বেশি সুন্দর। সে হাত-পা নেড়ে গলার স্বর উঠা-নামা করে পুরো ব্যাপারটা এমন ভাবে বলল যে কেউ তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বলতে পারল না, শুধু রানা ক্ষীণ স্বরে বলল, আমরা নেংটো হয়ে দৌড়াদৌড়ি করব তখন যদি স্থানীয় লোকজন পিটিয়ে দেয়।
মোতালেব ক্রুদ্ধ। গলায় বলল, স্থানীয় লোক? স্থানীয় লোক কোথায় পেলি সেন্ট মার্টিন হলো একটা প্রবাল দ্বীপ। জনমানব নেই। ধু ধু করছে বালি, নারিকেল গাছ, পাম গাছের সারি। আধো অন্ধকার আধো আলো।
ঠাণ্ডা লাগবে না, শীতের সময়?
ঠাণ্ডাতো লাগবেই। আদিম মানবের ঠাণ্ডা লাগে নি? তাছাড়া স্যূয়েটার গায়ে দিয়ে পানিতে নামলে কি তোর ঠাণ্ডা কম লাগবে? যাই হোক আমি আমার পরিকল্পনার কথা বললাম, তোরা যদি রাজি নাও হোস আমি একাই এগিয়ে যাব। যাকে বলে—একলা চল একলা চল রে।
রানা এবং বল্টু দুই জন প্রায় এক সঙ্গেই চায়ের দোকানে ঢুকল। রানার ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে সে ভয়াবহ দুর্যোগ অতিক্রম করে এসেছে। এখনো নিজেকে পুরোপুরি সামলে উঠতে পারে নি। বল্টুকেও কেমন যেন বিপর্যন্ত লাগছে। বল্টু ছোটখাট মানুষ, কোন সমস্যা হলেই সে আরো ছোট হয়ে যায় বলে মনে হয়।
সে সঞ্জুর পাশে বসতে বসতে বলল, অবস্থা কেরোসিন। আনুশকা আমার বাসায় এসেছিল, বলেছে সব মিলিয়ে পাঁচ জন মেয়ে আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে।
মোতালেব বলল, মাথা খারাপ না-কি। মেয়েদের আমরা সাথে নিচ্ছি না। নট এ সিংগোল ওয়ান।
বল্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, সেই কথা এখন বলে লাভ কি? তোরা আগে কোথায় ছিলি? তখন গদগদ গলায় কেন বললি—তোমরা মেয়েরা যদি যেতে চাও, যেতে পার। নো প্রবলেম।
আমি কোনদিন এই কথা বলি নি। মেয়েদের না নেয়ার পেছনে আমার একশ একটা যুক্তি আছে।
সেই একশ একটা যুক্তি তুই আনুশকাকে বুঝিয়ে বল। আমি তার বাসায় গিয়ে যুক্তি বুঝিয়ে আসব? আমার এত দায় পড়ে নি। বাসায় গিয়ে যুক্তি বুঝাতে হবে না। আনুশকা এখানে আসছে। আমি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছি—দশ মিনিটের মধ্যে চলে আসবে। তার আসার আগে আগে একটা কথা আমি পরিষ্কার বলতে চাই—মেয়েদের সঙ্গে নেয়ার আমি ডেড এগেইনস্টে। যদি তাদেরকে নিতে চাও, নাও আমার নামটা কেটে বাদ দিয়ে দাও। আমার স্ট্রেইট কথা।
সঞ্জু বলল, তোর এত আপত্তি কেন? যেতে চাচ্ছে যাক না। দল যত বড় হয়। ততই তো ভালো।
বলুন্টু কঠিন গলায় বলল, পাঁচটা মেয়ে সঙ্গে গেলে আমাদের ভেড়া বানিয়ে রাখবে। সারাক্ষণ ফরমাস, এটা কর, ওটা করা। জংলা জায়গায় যাচ্ছি।-কোথায় বাথরুম কোথায় কি। তারপর সুন্দর সুন্দর মেয়ে—ধর গুণ্ডা বা ডাকাত এ্যাটাক করে একটাকে ধরে নিয়ে গেল—তখন অবস্থা কি হবে? কিংবা ধর সমুদ্রে নেমেছে হঠাৎ ঢেউ এসে একটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। চোরাবালিতে আটকে গেল এক জন। তখন তোরা কি করবি আমাকে বল।
কেউ কোন কথা বলল না।
রানা আরেক দফা চ্যায়ের কথা বলে এসে ক্ষীণ স্বরে বলল, আমারো মনে হয়। মেয়েদের নেয়া ঠিক হবে না। তবু যদি নিতেই হয় তাহলে একটা লিখিত আন্ডারটেকিং দিয়ে নিতে হবে। লেখা থাকবে আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।
মোতালেব কড়া গলায় বলল, চুপ কর গাধা। যত দিন যাচ্ছে তুই ততই গাধা হচ্ছিস। ভদ্রসমাজে কথা বলার কোন যোগ্যতা তোর নেই। আমাদের ডিসিসান মেকিং এর সময় তুই দয়া করে একটা কথা বলবি না। নট এ সিংগেল ওয়ার্ড।
আনুশকাদের কালো বিশাল গাড়ি চায়ের দোকানের সামনে এসে থেমেছে। আনুশকা যখন সন্ধ্যার পর চলাফেরা করে তখন ড্রাইভার ছাড়াও ড্রাইভারের পাশে এক জন থাকে। তার নাম মফিজ। আনুশকার দিকে নজর রাখাই যার একমাত্র কাজ। আনুশকা হাসিমুখে গাড়ি থেকে নামল। চায়ের দোকানের সবাই ঘুরে তাকাল। অনেকক্ষণ কারো চোখে পলক পড়ল না। পলক না পড়ারই কথা। আনুশকার মতো রূপবতী সচরাচর চোখে পড়ে না।
চায়ের দোকানের মালিক উঠে দাঁড়িয়েছে—এমন কাস্টমার তার দোকানে আসে না। ইনি নিশ্চয়ই কাস্টমার না, অন্য কোন ব্যাপার। আনুশকা দোকানের মালিকের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, চিনি এবং দুধ ছাড়া এক কাপ চা দিতে পারেন? বলেই অপেক্ষা করল না—এগিয়ে গেল দলটির দিকে।
রানা অস্বস্তির সঙ্গে বলল, এখানে রাতের বেলা আসার কি দরকার ছিল?
আনুশকা বসতে বসতে বলল, কোনই দরকার ছিল না, তবু আসলাম। যাবার ব্যাপারটা চূড়ান্ত করতে চাই। সব মিলিয়ে আমরা পাঁচ জন মেয়ে যাচ্ছি। তাদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এসেছি।
বল্ট অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা তোমাদের নিচ্ছি না।
আমিও তাই আন্দাজ করছিলাম। কেন জানতে পারি?
অনেক ঝামেলা।
কি কি ঝামেলা তা কি বলা যাবে?
একশ একটা ঝামেলা। তার মধ্যে একটা বললেই তোমরা পিছিয়ে যাবে।
বল শুনি।
সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে কোন বাথরুম নেই।