আজ চায়ের দোকানে সঞ্জ, তারেক এবং মোতালেব বিকেল পাঁচটা থেকে বসে আছে। রানার খোঁজ নেই। একটা কাজের ছেলে বলে গেছে—এক্ষণ আইব, আপনাগো চা-পানি খাইতে বলছে।
রানার বন্ধুরা ইতিমধ্যে সবাই চার কাপ করে চা খেয়েছে। দশ টাকার পিয়াজু খেয়েছে। ডিমের অমলেট খেয়েছে। প্রজেক্ট দারুচিনি দ্বীপ নিয়ে তুমুল আলোচনাও চলছে। তবে পুরোপুরি ফাইনাল করা যাচ্ছে না। সবাই একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে অথচ দুই জন এখনো অনুপস্থিত। ৱানা এবং বল্টু। বল্ট থাকে বাসবোতে। সে আসবে একটা টিউশানী শেষ করে। আসতে আসতে নাটা বাজবো। রানা কেন আসছে না কে জানে। কোন একটা সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে।
রানার সমস্যা বেশ গুরুতর, তাদের টয়লেটের কমোডে কি যেন হয়েছে, হুড় হুড় করে পানি বের হয়ে চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্লাম্বার এক জনকে আনা হয়েছে। সে খানিকক্ষণ পর পর বিরস মুখে বলছে- কিছুই তো বুঝি না, পানে আহে কোন হান থুন?
সাদেক আলি একতলার বারান্দায় হাঁটাহাটি করছেন এবং গজরাচ্ছেন, গাধাটা করে কি। সামান্য জিনিসও পারে না। পানির মিস্ত্ৰি আনতে বললাম, রাস্তা থেকে কাকে ধরে নিয়ে এসেছে। কিছুই জানে না।
পানির মিস্ত্রি এই কথায় অপমানিত বোধ করে কি বলেছিল, রানার ভাই তাকে চুপ শুওরের বাচ্চা বলে ধাঁতানি দিয়েছেন।
মিস্ত্রীর শরীর বন্য মহিষের মতো। ঘাড় গর্দানে এক হয়ে আছে। তাকে শুওরের বাচ্চা বলতে হলে যথেষ্ট সাহস লাগে। সাদেক আলির সাহস সীমাহীন। মাঝখানে ঘাবড়ে গেছে রানা।
মিস্ত্রি থমথমে গলায় বলল, আপনে যে আমারে শুওরের বাচ্চা কইলেন। সাদেক আলি বললেন, চুপ। আবার মুখে মুখে কথা। রানা দে তো এই হারামজাদার গালে একটা চড়। আমাকে কোশ্চেন করে। সাহস কত।
এমন পরিস্থিতিতে বাড়ি ছেড়ে চায়ের দোকানে আসা সম্ভব না। রানা একবার সাদেক আলির দিকে একবার পানির মিস্ত্রির দিকে তাকাচ্ছে।
সাদেক আলি আরেকবার হুংকার দিলেন, দাঁড়িয়ে দেখছিস কি, চড় দে। রানা সত্যি-সত্যি চড়ি বসিয়ে দিল।
প্রজেক্ট দারুচিনি দ্বীপের ব্ল প্রিন্ট তৈরী প্রায় শেষ।
দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়েছে, মোতালেব টাকা পয়সার ব্যাপারগুলো দেখবে তাকে অর্থ মন্ত্রী বলা চলে। জেনারেল ফান্ড থাকবে তার কাছে। জেনারেল ফান্ড থেকে টাকা-পয়সা সেই খরচ করবে। খাওয়া-দাওয়া, নাশতা এইসব বিষয়ে কারো আলাদা কিছু করতে হবে না। সবাই একই ধরনের খাবার খাবে। একই নাশতা।
কল্যাণ মন্ত্রীর পোর্ট ফলিও সর্বসম্মতিক্রমে রানাকে তার অনুপস্থিতিতেই দেয়া হয়েছে। দলের সুখ-সুবিধা সে দেখবে। হোটেল খুঁজে বের করা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কিভাবে যাওয়া হবে এই সব ব্যবস্থা তার। ট্রেনের টিকিটও সেই কাটবে। সেন্ট মার্টিনে কিভাবে যেতে হবে তাও সেই খুঁজে বের করবে।
মোতালেব বলল, এন্টারটেইনমেন্টটা আমার হাতে ছেড়ে দে। গান-বাজনা দিয়ে হুলুস্থুলু করে দেব।
তারেক বিরক্ত গলায় বলল, তুই গান জানিস না-কি?
ক্যাসেট প্লেয়ার নিচ্ছি। রবীন্দ্র সংগীতের ছটা ক্যাসেট নিচ্ছি।
তারেক আরো বিরক্ত হয়ে বলল, যাচ্ছি এক ধরনের এক্সপিডিসনে—সেখানে রবীন্দ্র সংগীত? কুঁ কুঁ করে–সখী গো–ধর ধর।
টেগোরকে নিয়ে এই রকম ইনসালটিং কথা বললে কিন্তু ফাটাফাটি হয়ে যাবে। নাক বরাবর ফ্ৰী স্টাইল ঘুসি খাবি।
মোতালেব ক্রমাগত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে গিয়ে সে সিগারেট ছেড়ে দেবে—কাজেই যতটা পারা যায় খেয়ে নেয়া। সে দশ মিনিটের মাথায় তৃতীয় সিগারেটটা ধরাতে ধরাতে বলল, এতবড় একটা আন্দোলনের মাথায় আমাদের কি যাওয়া উচিত? আরেকবার ভেবে দেখ সবাই।
তারেক খুবই বিরক্ত হলো। রাগী গলায় বলল, আন্দোলন নিয়ে তুই বড় বড় বাত ছাড়বি না। গোটা আন্দোলনের সময় তুই ঘরে বসে ফিডার দিয়ে দুধ খেয়েছিস। আন্দোলন করেছি আমরা। পুলিশের বাড়ি খেয়ে মাথা ফাটিয়েছি। চার খান স্টীচ লেগেছে। এরশাদকে গেট আউট করেছি—এখন খানিকটা আমোদফুর্তি করা যায়।
আন্দোলন তো এখনো শেষ হয় নি।
ফিরে এসে করব। উইথ নিউ এনার্জি। এরশাদকে জেলখানায় নেয়ার জন্যে লাঠি মিছিল হবে। আমরা সবাই থাকব একেবারে ফ্রন্টে।
সঞ্জু উঁচু গলায় বলল, চুপ করতো— ইম্পৰ্টেন্ট কাজ বাকি আছে। দুটা ডিসিসান নিতে হবে। এক নাম্বার–শুভ্ৰ না-কি আমাদের সঙ্গে যেতে চাচ্ছে—ওকে নেয়া যাবে না।
মোতালেব বলল, মাথা খারাপ ওকে কি জন্যে নেব? আন্ধাকে নিয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে। পিসু করতেও তার কমোড লাগে।
সঞ্জু বলল, গোড়াতেই ওকে না করার দরকার ছিল। তখন তো কেউ কিছু বললি না।
তখন ভেবেছিলাম নিজ থেকেই পিছিয়ে পড়বে। এইসব পুতু পুতু জাপানি ডল শুরুতে খুব উৎসাহ দেখায় শেষ পর্যন্ত যায় না।
মোতালেব বলল, ওরটা আমার উপর ছেড়ে দে। আমি সামলাব।
সঞ্জু বলল, তুই কি ভাবে সামলাবি?
আমাদের আলটিমেট পরিকল্পনার কথা বললেই সে চোখ বড় বড় করে বলবে—আমি যাব না।
মোতালেবের আলটিমেট পরিকল্পনা অবশ্যি এখনো দলের অনুমোদন পায় নি। তবে সরাসরি কেউ এখন পর্যন্ত না বলে নি। মেয়েরা যদি শেষ পর্যন্ত সঙ্গে যায় তাহলে এই পরিকল্পনার প্রশ্নই উঠে না। মেয়েরা সম্ভবত যাবে না। মেয়েরা সব ব্যাপারে শুরুতে খুব উৎসাহ দেখায়, তারপর যেই বাড়ি থেকে একটা ধমক খায় ওম্নি সব ঠাণ্ডা।