চুপ করে শুয়ে থাক।
শুয়েই তো আছি। মাঝে মাঝে মনটা খারাপ হয়, ভাবি কি করেছি আমি?
গম্ভীর হয়ে থাক, এই জন্যে বোধ হয় একটু দূরে দূরে থাকে। গম্ভীর হয়ে থাকলে অসুবিধা কি? একটা লোক যদি গম্ভীর হয়ে থাকে তাহলে তাকে কি কিছু বলা যাবে না?
ওরা ভাবে ওদের কথা শুনলে তুমি রাগ করবে। তাই… ..এটা তো তুমিও ভাব।
আমি ভাবব কেন?
তুমি যদি না ভাব তাহলে সঞ্জুর জরুরী কথাটা আমাকে বললে না কেন? আমি রাগ করতে পারি। এই ভেবেই তো তুমি বলছি না।
ফরিদা চাপা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, সঞ্জু তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব নিয়ে এক জায়গায় বেড়াতে যেতে চায়।
কোন জায়গায়?
সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ড।
এটা শুনে আমি রাগ করব কেন? রাগ করার এখানে কি আছে? যুবক বয়সী। এই বয়সে নানান জায়গায় ঘুরার ইচ্ছা তো হবেই। সত্ত্বর বয়স কত এখন?
তেইশ।
তেইশ বছর বয়সে আমি একা-এয়াক দার্জিলিং গিয়েছিলাম।
আমাকে তো কখনো বল নাই।
বাড়ি থেকে রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। শুধু বড় মামা জানত। বড় মামা–পাঁচশ টাকা দিয়েছিলেন।
রাগ করেছিলে কেন?
আমার বাবা ছিল খুব রাগী। রাগলে উনার মাথা ঠিক থাকত না। একবার রোগে গেলেন তারপর সব লোকজনের সামনে জুতো পেটা করলেন।
সেকি। এমন কি করেছিলে যে জুতাপেটা করতে হলো। এত বড় ছেলেকে জুতোপেটা করবে। এটা একটা কথা হলো। কেমন মানুষ উনি?
বাবার সম্পর্কে এমন তাচ্ছিল্য করে কথা বলবে না। উনার রাগ ছিল বেশী। রাগ বেশি থাকা অপরাধ না। সঞ্জু যাচ্ছে কবে?
এখনো ঠিক হয় নাই। সামনের সপ্তাহে যাবে বোধ হয়।
ওর গরম কাপড় তো কিছু নাই। একটা সুয়েটার কিনে দিও। আর একটা মাফলার। সমুদ্রের তীরে খুব ঠাণ্ডা হওয়ার কথা। হুঁ হুঁ করে বাতাস। ফট করে ঠাণ্ড লেগে যাবে। কানো ঠাণ্ডা লাগে সবার আগে। আমার গরম চাদরটাও দিয়ে দিও।
আচ্ছা।
দেশ-বিদেশ ঘুরলে মন বড় হয়। কত কি দেখা যায়। শেখা যায়। আমার টাকা-পয়সা নাই। টাকা-পয়সা থাকলে দেশ-বিদেশে পাঠাতাম। দেশের ভেতর এখানে-ওখানে যেতে চায়—যাবে। এটা শুনে আমি রাগ হব কেন?
ফরিদা স্বামীর মাথার চুল টানতে টানতে বললেন, দাৰ্জিলিং তোমার কাছে কেমন লেগেছিল বল তো?
ভালো।
কেমন ভালো বল। শীতের সময় গিয়েছিলে?
হুঁ।
খুব শীত না?
হুঁ।
কতদিন ছিলে দাৰ্জিলিঙে?
সোবাহান সাহেব জবাব দিলেন না। মনে হলো তার শরীর একটু যেন কেঁপে উঠল। ফরিদা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। সোবাহান সাহেবের চোখ ভেজা। তিনি নিঃশব্দে কাঁদছেন।
রানার বড় ভাই
রানার বড় ভাই-এর বাড়ি আন্দাবরে।
পাঁচতলা হুলুস্থল ধরনের বাড়ি। যার একতলার দুটি ইউনিটে রানারা থাকে। বাকি চারতলা ভাড়া দেয়া হয়েছে। রানা মূলত এই বাড়ির এক জন কেয়ারটেকার। পরপর তিনবার ইন্টারমিডিয়েট ফেল করবার পর রানার বড় ভাই—সাদেক আলি রানাকে একদিন ডেকে পাঠান এবং খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেন পড়াশোনা তোকে দিয়ে হবে না—তুই বরং ব্যবসা পাতি কর।
রানা সঙ্গে সঙ্গে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে এবং খুব নিশ্চিন্ত বোধ করে।
আজকাল পয়সা হচ্ছে কনস্ট্রাকসনে, ব্রিক ফিল্ড একটা ভালোমতে চালাতে পারলে লাল হয়ে যাবি। পারবি না?
রানা আবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে।
আচ্ছা তাহলে তাই করব। পড়াশোনা তোর লাইন না। না-কি আরেকবার পরীক্ষা দিতে চাস? ভেবে বল। লাস্ট চান্স একটা নিবি?
না।
তিনে যার হয় না চারেও তার হবে না। আচ্ছা যা ব্রিক ফিল্ড একটা করে দেব-ইনশাআল্লাহ।
এইসব কথা-বার্তা আজ থেকে ন’মাস আগের। রানা মোটামুটি নিশ্চিত যে ব্রিক ফিল্ডের রমরমা দিন তার আসছে। শুধু সময়ের ব্যাপার। গত নমাসে বাড়ির কেয়ার টেকারের দায়িত্ব তার ঘাড়ে চেপেছে। সে এই কাজ বেশ মন দিয়ে করছে। তিন তলার ভাড়াটের ইলেকট্রিক ফিউজ জ্বলে গিয়ে ফ্ল্যাট অন্ধকার— রানাকে দেখা যাবে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে ফিউজ ঠিক করছে। দুই তলার ভাড়াটে দেয়ালে পেইনটিং বসাবে। মিস্ত্রী ডেকে দেয়ালে ফুটো করার কাজের পুরো দায়িত্বই তার। এইসব ছাড়াও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তার ডাক পড়ছে। চারতলার ভাড়াটের ছেলের আকিকা। দুটা খাসি আমিন বাজার থেকে কিনে আনা, মৌলানার ব্যবস্থা করা, আওলাদ হোসেন লেন থেকে কিসমত বাবুর্চিকে নিয়ে আসার জটিল সব কাজ সে আনন্দ এবং আগ্রহের সঙ্গে করে।
রানার স্বভাব খুব মধুর। না হেসে কোনো কথা বলতে পারে না। যে যাই বলে তাই সে সমর্থন করে। কোনো ঝগড়া-ঝাটি শুরু হলে মধ্যস্ততার জন্যে অসম্ভব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্কুল এবং কলেজ জীবনের বন্ধুদের জন্যে তার মমতার কোনো সীমা নেই। সে নিজে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে, কিন্তু অন্যদের পড়াশোনা ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার সময় সে তার প্রতিটি বন্ধুর পরীক্ষা কেমন হয়েছে তার খোজ প্রতিদিন নিয়েছে। মোতালেবের ফোর্থ পেপার খুব খারাপ হয়েছে। পেপার ক্র্যাশ করতে পারে শুনে সে দুঃশ্চিন্তায় রাতে ভালো ঘুমুতেও পারে নি।
রিং রোডের মাঝামাঝি একটা চায়ের রেস্টুরেন্টে রানা বাকির খাতা খুলে রেখেছে। সেই বাকির খাতায় তার চার বন্ধুর নাম লেখা। দোকানদারকে বলা আছে—এই চার জন এবং এই চার জনের সাথে কোন বন্ধু বান্ধব থাকলে তারাও বাকি খেতে পারবে। যা খেতে চায় তাই।
রানার বন্ধুরা এই চায়ের দোকানেই রানার সঙ্গে আড্ডা দেয়। সপ্তাহে অন্তত একদিন বিকাল তিনটা থেকে রাত দশটা-এগারটা পর্যন্ত আড্ডা চলে। রাত বেশি হয়ে গেলে দোকানেই পাটির উপর ঘুমিয়ে পড়ার ব্যবস্থা আছে। বালিশ এবং এক্সট্রা মশারী রানা বাড়ি থেকে নিয়ে আসে তবে বন্ধুদের কখনো বাড়িতে নিতে পারে না। রানার বড় ভাই পছন্দ করেন না।