হ্যাঁ।
অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছ। টাকা চাইলেই দিবে?
দশটা মোটে টাকা। দিশ টাকা মোটেই সামান্য না। দশ দিন যদি দশ টাকা করে দাও তা হলে কত হয়? একশ। একশ টাকায় দশ সের চাল পাওয়া যায়। তার উপর যুদ্ধ লেগে গেছে—থার্ড ওয়ান্ড-ওয়ার। সারা পৃথিবীর অবস্থা কাহিল।
এইখানে তো আর যুদ্ধ হচ্ছে না।
না বুঝে কথা বলবে না। যুদ্ধের এফেক্ট সারা পৃথিবীতে পড়বে। অলরেডি পড়ে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কোথায় হয়েছিল? ইউরোপে। লোক মারা গোল কোথায়? বাংলাদেশে। লাখ লাখ লোক। এক জন দুই জন না। এইবার মারা যাবে কোটিতে।
ফরিদা বললেন, যাই তোমার চা নিয়ে আসি।
কথা শেষ করে নেই তারপর যাও। বস।
ফরিদা বসলেন। শংকিত মনেই বসলেন। এই মানুষটার বক্তৃতা দেয়ার অভ্যাস আছে। একবার বক্তৃতা শুরু হলে ঘণ্টা খানিক চলবে। প্রতিটি কথা শুনতে হবে খুব মন দিয়ে। কথার মাঝখানে এদিক ওদিক তাকালেই মানুষটা রেগে যায়। অবশ্য বক্তৃতা সে শুধু তাঁর সঙ্গেই দেয় অন্য কারো সঙ্গে একটি কথাও বলে না। সোবাহান সাহেব, খবরের কাগজ নামিয়ে রেখে গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার মেয়েরা কোথায়?
মুনার বান্ধবীর জন্মদিন। সে দুই বোনকে নিয়ে ঐখানে গেছে। ওরা গাড়ি দিয়ে নিয়ে গেছে। রাতে সেখানে খাবে তারপর গাড়ি করে দিয়ে যাবে।
গাড়ি করে নিয়ে যাক আর হেলিকপ্টারে করেই নিয়ে যাক —যার বান্ধবীর দাওয়াত সে যাবে। গুষ্টিশুদ্ধো যাবে কেন? এইসব আমার পছন্দ না।
মাঝে মাঝে একটু-আধটু বেড়াতে গেলে কি অসুবিধা?
অসুবিধা আছে। এতে পাড়া-বেড়ানি অভ্যাস হয়। দিন-রাত খালি ঘুর-ঘুর করতে ইচ্ছা করে। মেয়েদের জন্যে এটা ভালো না। আমাদের অফিসের করিম সাহেবের এক ছোটশালি বি.এ ফাষ্ট ইয়ারে পড়ে। তার এ রকম পাড়া-বেড়ানি স্বভাব। হুট হাট করে এখানে যায়, ওখানে যায়। এক দিন কোন বন্ধুর খোজে দুপুরে ছেলেদের এক হোস্টেলে গিয়ে উপস্থিত… তারপর থাক বাকিটা আর বলতে চাই না…
শুনি না তারপর কি?
না থাক। সব কিছু শোনা ভালো না। যাও চা-টা নিয়ে আস।
চা এনে ফরিদা দেখলেন, মানুষটা বমি করে সমস্ত ঘর ভাসিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে বিছানায় বসে আছে। চোখ রক্তবর্ণ। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে।
ফরিদা ভীত গলায় বললেন, কি হয়েছে?
সোবাহান সাহেব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বললেন, শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। নিঃশ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে।
সে কি?
তিনি পেটে হাত দিয়ে আবার বমি করলেন।
এই কঠিন গম্ভীর মানুষটা অসুখ-বিসুখ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। অল্প শরীর খারাপেই শিশুর মতো হয়ে যায়। আজ শরীরটা বেশি রকম খারাপ। ফরিদা হাত-মুখ ধুইয়ে তাঁকে মেয়েদের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এসেছেন। নিজের শোবার ঘর ধুয়ে মুছে মেয়েদের ঘরে যখন ঢুকলেন তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। সোবাহান সাহেব কম্বল গায়ে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে আছেন। তার গায়ে জুর। অন্ধকার ঘরে ভন ভন করে মশা উড়ছে। ফরিদা মশারী খাটিয়ে স্বামীর বিছানায় উঠে এলেন। কোমল গলায় বললেন, শরীরটা কি বেশি খারাপ লাগছে?
হুঁ।
ফরিদা স্বামীর মাথা কোলে তুলে নিলেন। মায়ায় তাঁর মনটা ভরে যাচ্ছে। মানুষটাকে এখন একেবারে শিশুর মতো লাগছে। কোলে মুখ গুজে চুপচাপ পড়ে আছে। একটু নড়ছেও না।
শরীর এখন কি একটু ভালো লাগছে?
হুঁ।
ঘুমুতে চেষ্টা কর। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
আচ্ছা।
ফরিদা স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কল্পনায় সেন্ট মাটিন আইল্যান্ড দেখতে লাগলেন। সমুদ্রের মাঝখানে ছোট্ট একটা দ্বীপ। চারদিকের পানি ঘন নীল। যে দিকে তাকানো যায় নীল ছাড়া আর কিছুই নেই। সমুদ্রের নীলের সঙ্গে মিশেছে আকাশের নীল। দ্বীপে কোন জনমানব নেই, গাছপালা নেই। মরুভূমির মতো ধু ধু বালি। জোছনা রাতে সেই বালি চিক চিক করে জ্বলে।
সোবাহান সাহেব অস্পষ্ট স্বরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। ফরিদা বললেন, ঘুম আসছে না?
না।
আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সেন্ট মাটিন আইল্যান্ডে কি গাছপালা আছে?
হুঁ আছে।
তুমি গেছ কখনো সেখানে?
না।
তাহলে জান কি করে?
সোবহান সাহেব সেই কথার জবাব না দিয়ে উঠে বসলেন। ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমাকে বাথরুমে নিয়ে যাও। আবার বমি আসছে।
তাঁর জ্বর আরো বেড়েছে। চোখ হয়েছে রক্তবর্ণ।
ফরিদা তাকে ধরে ধরে বিছানা থেকে নামালেন। সোবাহান সাহেব বিড় বিড় করে বললেন, ঘর একদম খালি। বাচ্চা-কাচ্চারা না থাকলে আমার ভালো লাগে না, এরা কখন আসবে?
এসে পড়বে।
সঞ্জ, সঞ্জু কোথায় গেছে?
বন্ধুর বাসায়।
সন্ধ্যার পর বন্ধুর বাসায় যাওয়া-যাওয়ি আমার পছন্দ না।
রোজ তো যায় না। মাঝে-মধ্যে জরুরী কাজ থাকলে যায়।
কি জরুরী কাজ?
ফরিদা চুপ করে রইলেন। সোবাহান সাহেব বললেন, বমি ভাবটা চলে গেছে। আমাকে শুইয়ে দাও।
মাথায় পানি ঢালব? অনেক জ্বর।
পানি ঢালতে হবে না।
তিনি আবার বিছানায় কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লেন। একটি কম্বলে শীত মানছে না। গায়ের উপর আরেকটা লেপ দেয়া হলো। পায়ে মোজা পরিয়ে দিয়ে ফরিদা শংকিত মনে অপেক্ষা করতে লাগলেন। এক জন ডাক্তারকে খবর দেয়া দরকার। কাকে দিয়ে খবর দেয়াবেন? বাড়িওয়ালার ছেলেটাকে বললে সে কি এনে দেবে না?
ফরিদা?
কি।
তোমার ছেলে-মেয়েরা আমাকে এত ভয় পায় কেন? আমি কি কখনো এদের গায়ে হাত তুলেছি না। উঁচু গলায় কোনো কথা বলেছি?
ভয় পায় না।
অবশ্যই পায়। কেউ আমাকে একটা কথা এসে বলে না। যা কিছু বলার বলে তোমাকে।