সুকান্তর।
অবিকল এই রকম একটা কবিতার লাইন ইংরেজি কবিতায়ও পড়েছি।– Give me some salt, I will eat the moon…পড়েছ এই কবিতা?
না।
ইংরেজি কবিতা তুমি পড় না?
না।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব উঠতে উঠতে বললেন—তুমি আজকের দিনটা চিন্তা কর। কাল সকালে আমাকে বলবে কি করতে চাও। যা করতে চাও তাই হবে। বাইশ বছরের যুবক ছেলের উপর আমি কিছুই ইম্পোজ করতে চাই না। অবশ্যি আরেকটি ব্যাপারও আছে। দেশের সব মানুষ যেখানে গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলন করছে সেখানে তোমরা মজা করার জন্যে বেড়াতে যাচ্ছ এটা কেমন কথা?
রেহানা বললেন, শুভ্র কখনোই কিছু চায় না। হঠাৎ ইচ্ছে হয়েছে—ঘুরে আসুক না।
ইয়াজউদ্দিন বিরক্ত গলায় বললেন, ওর কথা ওকেই বলতে দাও। শুভ্ৰ, তুমি কি যেতে চাও?
শুভ্র বলল, না। বলেই দ্রুত নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। তার চোখে পানি এসে গেছে। বাবা-মাকে সে চোখের পানি দেখাতে চায় না।
ইয়াজউদ্দিন হাতের ঘড়ি দেখলেন। বিশ মিনিট পার হয়েছে। তিনি উঠে পড়লেন। রেহানাকে বললেন, ও মন খারাপ করে না বলেছে। ওকে যেতে বল। ঘুরে আসুক। পৃথিবীর রিয়েলিটির সঙ্গে খানিকটা পরিচয় হোক।
সঞ্জু বারান্দায় পাটি পেতে খেতে বসেছে
সঞ্জু বারান্দায় পাটি পেতে খেতে বসেছে।
তাকে দেখেই মনে হচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্তা। বড় বড় নলা বানিয়ে মুখে দিচ্ছে। সঞ্জুর মা ফরিদা তার সামনেই বসে আছেন। অন্য দিন সঞ্জু খেতে খেতে গল্প করে আজ তাও করছে না।
ফরিদা অস্বস্তি বোধ করছেন। দ্রুত শূন্য হয়ে আসা থালার দিকে তিনি ভীত চোখে তাকিয়ে আছেন। ভাত আর নেই। থালার ভাত শেষ হয়ে গেলে আর দেয়া যাবে না। ছেলেটা কি ক্ষিধে-পেটে উঠবে? আজি ভাত কম পড়ল কেন? তিনি নিজে মেপে-মেপে সাড়ে চার পট চাল দিয়েছেন।
সঞ্জু মার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি খেয়েছ মা?
তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, হুঁ।
এটা বলতেও তার লজ্জার সীমা রইল না। ফরিদা ক্ষিদে সহ্য করতে পারেন না। একেবারেই না। রান্না হওয়া মাত্র গরম গরম ভাত খেয়ে নেন। তখনো হয়ত তরকারি হয় নি, ডালটা শুধু নেমেছে।
সঞ্জুর ভাতের থালা প্রায় শূন্য। এক্ষুণি হয়ত সে বলবে—আর চারটা ভাত দাওতো মা। ফরিদা মনে মনে বললেন, আল্লাহু আজ যেন সে ভাত না চায়। খাওয়া শেষ করে যেন উঠে পড়ে।
সঞ্জু ভাত শেষ করে ফেলেছে। পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে। ফরিদা চাপা স্বরে বললেন, খাওয়া হয়ে গেল?
হুঁ।
আর চারটা ভাত নিবি না?
না। পান থাকলে একটা পান দাওতো মা।
ফরিদা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোরতো দেখি পান খাওয়া অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। তুই ছাত্র মানুষ। তোর কি দাঁত লাল করে পান খাওয়া ঠিক?
ঠিক না হলে দিও না।
সঞ্জু হাত ধুতে উঠে গেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছে। মুখ ভৰ্তি করে পানি নিয়ে কুলি করে কলঘরের কাছে রাখা। টবে ফেলার চেষ্টা করছে। ছেলেবেলার অভ্যাস। সব ভাই-বোন এই জায়গায় দাঁড়িয়ে কুলি করে টবে পানি ফেলার চেষ্টা করবে। কুলির পানিতে উঠান মাখামাখি। কত বকা দিয়েছেন লাভ হয় নি। দশ বছর আগের টবি এখনো আছে। গাছ বদল হয়েছে। শুরুতে ছিল গোলাপ গাছ, তার পর কয়েক বছর মরিচের গাছ, একবার ছিল টমেটোর গাছ-খুব টমেটো হয়েছিল সেবার। এখন আবার একটা গোলাপ গাছ। গাছ ভৰ্তি করে কলি এসেছে। এখনো ফুল ফোটেনি।
সঞ্জু পান নে।
সঞ্জু পান হাতে নিতে নিতে বলল, ভাত যদি চাইতাম তা হলে মা তুমি বিপদে পড়তে। ভাততো আর ছিল না।
ফরিদা বিব্রত গলায় বললেন, কে বলল ছিল না?
আমি বুঝতে পারি।
ইস কি আমার বুঝনেওয়ালা—আয় রান্নাঘরে নিজের চোখে দেখে যা।
সঞ্জু হাসতে হাসতে বলল, এম্নি বললাম।
ফরিদা মুগ্ধ চোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সঞ্জু হাসলেই তার গালে টোল পড়ে। দেখতে এমন মজা লাগে। ইচ্ছা করে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিতে। গালে টোল-পড়া মেয়েরা দুৰ্ভাগ্যবতী হয়, ছেলেদের বেলায় কি এসব কিছু আছে?
দশটা টাকা দিতে পারবে মা?
সকালে না পাঁচ টাকা নিলি। ঐটা বাস ভাড়াতেই শেষ। এখন যাব আদাবর, ফিরতে ফিরতে রাত এগারটা।
এত রাত পর্যন্ত বাইরে থাকবি?
উপায় কি মা। ফাইন্যাল প্ল্যানিং করতে হবে। সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে যাবার ব্ল প্রিন্ট আজ রাতে তৈরী হবে। আমাদের এই প্রজেক্টের নাম কি জান? প্রজেক্টের নাম হচ্ছে—প্ৰজেক্ট দারুচিনি দ্বীপ।
দারুচিনি দ্বীপ কেন?
রোমান্টিক ধরনের একটা নাম দেয়া হল—এই আর কি? দুইটা নাম সিলেকটেড হয়েছিল—প্রজেক্ট দারুচিনি দ্বীপ এবং প্রজেক্ট কালাপানি। লটারীতে দারুচিনি দ্বীপ উঠে এল। এটা আমার দেয়া নাম।
ফরিদা হালকা গলায় বললেন, কি যে তোদের কাণ্ডকারখানা। বেড়াতে যাবি তাও আবার একটা না একটা—প্রজেক্ট হেন, প্রজেক্ট তেন…
এইসব তোমরা বুঝবে না মা। আর শুধু বেড়াতে যাচ্ছি। তাতো না আরো ব্যাপার আছে।
আর কি ব্যাপার? তোমাকে বলা যাবে না। সঞ্জু মার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, টাকা দিতে হবে মনে আছে তো মা?
মনে আছে।
এক হাজার টাকা। সবাই মিনিমাম এক হাজার নিচ্ছে। দিতে পারবে তো?
পারব। লাষ্ট মোমেন্টে যদি বল—টাকার জোগাড় হয় নি। তাহলে সর্বনাশ।
কজন যাচ্ছিস?
এখনো ঠিক হয় নি। আজ ফাইন্যাল হবে। ইয়ে মা শোন—আমাদের সঙ্গে কয়েকটা মেয়েও হয়ত যাবে।
কি বললি?
ওরা যেতে চাচ্ছে। আমরা নিব কি-না এখনো ঠিক করিনি। নাও নিতে পারি। ওদের নেয়া মানেই যন্ত্রণা।