শুভ্র।
জ্বি।
তুমি কি সাইকেল চালাতে জান?
না কেন বল তো?
এ বাড়িতে তো কোন সাইকেল ছিল না, কাজেই…
এ বাড়িতে তো গাড়ি আছে। গাড়ি চালাতে পার?
না।
সাঁতার জান?
না।
তুমি কিন্তু কিছুই জান না। তোমার জগৎ—অভিজ্ঞতা শূন্য ক্ষুদ্র জগৎ।
একেবারে ক্ষুদ্রও না। আমি প্রচুর পড়ি। বই পড়ে আমি লেখকদের অভিজ্ঞতা নিয়ে নেই।
ধার করা অভিজ্ঞতা কোনো অভিজ্ঞতা না।
তুমি কি আমার উপর খুব রাগ করেছ?
না, রাগ করি নি।
তাহলে এতসব কঠিন কঠিন কথা কেন বলছ? তোমাকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ নাম্বার দিয়েছি বলে বলছ?
না। তুমি যদি আমাকে পঁচানব্বুইও দিতে তাহলেও বলতাম। আগের থেকে প্ল্যান না করে আমি কিছু করি না। আজ সারাদিনে আমি কি কি করব তা এই কার্ডে লেখা আছে। দুই নাম্বারে কি লেখা একটু পড়ে দেখো।
দুইনম্বরে লেখা—শুভ্রর সঙ্গে তাঁর ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলা।
আমার কথা বিশ্বাস হলো শুভ্র?
তুমি আমার ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলছি না—।
যা বলছি তা হলো প্রিলগ। মূল গানের আগে তবলার ঠিকঠাক হয়। এ হচ্ছে তবলার ঠিকঠাক। তোমার মাকে ডেকে নিয়ে এস। দুইজনের সামনেই কথা বলি।
মা কি আসবে?
না আসারই সম্ভাবনা। তবু বলে দেখি।
রেহানা এসে বসলেন। স্বামীর দিকে একবারও তাকালেন না। তার মুখ কঠিন। তিনি ছোট ছোট করে শ্বাস ফেলছেন।
ইয়াজউদ্দিন তার চেয়ার ছেড়ে স্ত্রীর পাশের চেয়ারে এসে বসলেন। রোহন আরো শক্ত হয়ে গেলেন। ইয়াজউদ্দিন স্ত্রীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ছেলের চোখে চোখ রেখে বললেন, তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি আরাম পাই না। কথা বলার সময় আমি তোমার চোখ দেখতে পাই না।
বাবা, চশমা খুলে ফেলব?
না, তার দরকার নেই। তোমার মা গত রাতে তোমাদের এক পরিকল্পনার কথা বলছিলেন—তোমরা কয়েক বন্ধু না-কি সেন্ট মার্টিন আইল্যান্ডে জোছনা রাত কাটাবে?
হ্যাঁ।
খুবই ভালো কথা, কিন্তু আমার তো ধারণা তোমার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই।
স্কুলে ওদের সঙ্গে পড়েছি।
স্কুলের পরেও যোগাযোগ ছিল?
খুব কম। মাঝে মধ্যে আসত।
আমার মনে হয় কোনো ধার টারের প্রয়োজন হলে ওরা তোমার কাছে আসে।
শুভ্ৰ কোনো জবাব দিল না।
তিনি গলার স্বর স্বাভাবিকের চেয়ে এক ধাপ নীচে নামিয়ে বললেন, শুভ্ৰ, দেশে এখন যে আন্দোলন চলছে—সেই বিষয়ে তোমার মত কি? গণতন্ত্রের আন্দোলনের কথা বলছি।
শুভ্ৰ বুঝতে পারল না-বাবা কেন হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টালেন। সে কোনো জবাব দেয়ার আগেই ইয়াজউদ্দিন সাহেব বললেন, গোটা আন্দোলনে তুমি একদিনও বের হওনি। ছাত্ররা মিটিং মিছিল করেছে, কার্ফু ভেঙ্গেছে, গুলি খেয়ে মরেছে— তুমি দরজা বন্ধ করে ঘরে বসেছিলো। কেন জানতে পারি?
আন্দোলনে যাওয়া তোমরা পছন্দ করতে না। আমি ওদের সঙ্গে যোগ করলে তোমরা রাগ করতে। আমি তোমাদের রাগাতে চাই নি।
ঠিকই বলেছি, রাগ করতাম। আন্দোলন সবাইকেই করতে হবে তা না।
শুভ্ৰ হঠাৎ বাবাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, দেশে গণতন্ত্র আনার জন্যে আন্দোলন কি ছোট কাজ?
তিনি এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তাকে খানিকটা বিরক্ত মনে হলো। চোখের নিচের চামড়া একটু যেন কুঁচকে গেল। কপালে ভাজ পড়ল। অবশ্যি খুব সহজেই তিনি নিজেকে সামলে নিলেন।
ইয়াজউদ্দিন সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকালেন, দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে হাতঘড়ি দেখলেন। এখনো তার হাতে কুড়ি মিনিট সময় আছে। ছেলের সঙ্গে কথা বলতে কুড়ি মিনিটের বেশি লাগার কথা না। শুভ্ৰ কথার পিঠে কথা বলে না। কথার পিঠে কথা বললে আরো বেশি সময় লাগতো।
শুভ্র।
জ্বি।
তোমার এই বন্ধুরা মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলে, তাই না?
জ্বি।
সাধারণত হাইলি রোমান্টিক পরিকল্পনা মিডল ক্লাস ফ্যামিলির ছেলেমেয়েদের মাথায় আসে। এই নিয়ে মাসের পর মাস তারা আলোচনা করে। প্ল্যান প্রোগ্রাম হয়, তার পর এক সময় সব ভেস্তে যায়। বেশির ভাগ সময়ই ভাঙে অর্থনৈতিক কারণে। আশা করি তোমাদেরটা ভাঙবে না।
না ভাঙবে না। আসছে মঙ্গলবার আমরা রওনা হচ্ছি। শুক্রবার পূর্ণিমা। আমরা সেন্ট মাটিনে গিয়েই পূর্ণিমা পাব।
ভেরী গু্ড। চাঁদের আলোয় দ্বীপে ঘুরাঘুরি করবে?
জ্বি
ইন্টারেস্টিং। কিন্তু কথা হচ্ছে কি, যাদের সঙ্গে যাচ্ছ তারা কি তোমার ভালো বন্ধু?
ওরা আমাকে খুব পছন্দ করে।
আমার মনে হয় তুমি ভুল বলছি। ওরা তোমার অর্থ বিত্ত এইসব পছন্দ করে। তোমার মধ্যে পছন্দ করার মতো গুণাবলি বিশেষ নেই। তুমি মজার গল্প করতে পার না। আসর জমাতে পার না। তুমি অত্যন্ত ইস্ট্রোভার্ট ধরনের এক জন যুবক-যে এখনো বালকের খোলস ছাড়তে পারে নি।
তুমি কি আমাকে যেতে নিষেধ করছ?
না। তোমার বয়স বাইশ, তুমি নিশ্চয়ই তোমার ইচ্ছামত চলতে পার। আমি শুধু সমস্যাগুলোর প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রথমেই বলছি ভ্ৰমণ পরিকল্পনা কাগজে-কলমে যতটা ইন্টারেস্টিং বাস্তবে কখনোই তত ইন্টারেটিং হয়। না। দ্বীপে পৌঁছতে তোমাদের খুব কষ্ট করতে হবে—এত কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তোমার নেই। দ্বীপে পৌঁছার পর শীতে কাবু হবে। বাথরুমের অভাবে কাবু হবে। তুমি হঠাৎ অবাক হয়ে লক্ষ্য করবে তোমার বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গও ততটা ইন্টারেষ্টিং মনে হচ্ছে না। তারা অশ্লীল সব রসিকতা করবে। তুমি তা-ও সহ্য করতে পারবে না।
তুমি মনে করছি আমার যাওয়া উচিত নয়?
অবশ্যই তোমার যাওয়া উচিত। ছোট্ট একটা প্রবাল দ্বীপ। চারপাশে সমুদ্র, আকাশে Full moon–খুবই একসাইটিং। তুমি যাবে তো বটেই। তুমি তোমার মতো করে যাবে। আমি কক্সবাজারের ডিসি সাহেবকে টেলিফোন করে দেব। এ ছাড়াও আরো কিছু লোকজনকে বলব যাতে—টেকনাফ থেকে সেন্ট মাটিনে যাবার জন্যে ভালো জলযান থাকে। দ্বীপে চোর ডাকাত থাকতে পারে। কাজেই সঙ্গে পুলিশ দরকার। খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকাও প্রয়োজন। ক্ষুধা পেটে পূর্ণিমার চাদকে রুটির মতো লাগে। কার কথা যেন এটা?